1. : admin :
মনিরুল ইসলামের ‘পথভোলা পথিকেরা’ লেখার মুন্সিয়ানা ও স্টাইলের মাইলফলক - দৈনিক আমার সময়

মনিরুল ইসলামের ‘পথভোলা পথিকেরা’ লেখার মুন্সিয়ানা ও স্টাইলের মাইলফলক

অনলাইন ডেস্ক
    প্রকাশিত : বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৩

_মোহাম্মদ অলিদ বিন সিদ্দিকী তালুকদার

১৩২২ বঙ্গাব্দের ২১ চৈত্র, খৃষ্টাব্দ ১৯১৬-এর ৩ এপ্রিল, শান্তিনিকেতনে বসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি ’আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি… । পরে এতে স্বরলিপিকায় আনেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। …আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি/ সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা/ আমায় চেন কি/ চিনি তোমায় চিনি, নবীন পান্থ–/ বনে বনে ওড়ে তোমার রঙিন বসনপ্রান্ত/ ফাগুন প্রাতের উতলা গো, চৈত্র রাতের উদাসী/ তোমার পথে আমরা ভেসেছি / ঘরছাড়া এই পাগলটাকে এমন ক’রে কে গো ডাকে করুণ গুঞ্জরি ….।
এমন করে লেখা কাব্যের জনক রবীন্দ্রনাথ পথিক ছিলেন, পথভোলা ছিলেন না। এর মাঝেও পথিক রূপে সন্ধ্যাবেলার চামেলি, সকালবেলার মল্লিকাদের কথা এনেছেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু পথিক ছিলেন না, ছিলেন বিশ্বপথিক। আশি বছরের জীবনে, তৎকালীন অনগ্রসর পৃথিবীর পটভূমিতে, দুটি বিশ্বযুদ্ধের অতি-সঙ্কুল পরিস্থিতি পেরিয়েও তিনি অন্তত ডজনবার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণ আওতায় ছিল ফ্রান্স, হংকং, চীন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, অষ্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, ইতালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরি, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রিস, মিশর, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জামান, বার্মা, হল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া, ইরান, ইরাক, শ্রীলঙ্কাসহ তৎকালের প্রায়-পুরোটা পৃথিবী। সেই সুবাদে এই পথিক বিশ্বের পথিকদেরও চিনেছেন। চিনি গো চিনি ওগো বিদেশিনিতে রয়েছে সেই কথা।
মনিরুল ইসলামের পথভোলা বইটি একটু বেশি সময় নিয়ে পড়ে রবীন্দ্রনাথের পথভোলা পথিকের কথা মনে পড়ছে। সময় এবং প্রেক্ষিত ভিন্ন। প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পথভোলা পথিকেরা বইটির ক্যানভাসও ভিন্ন। সাবজেক্ট-অবজেক্ট আরো ভিন্ন। এতে সন্ধ্যাবেলার চামেলি, সকালবেলার মল্লিকাদের কথা নেই। আছে স্বদেশি-প্রবাসীদের কথা। মেয়ের বাপের অসহায়ত্ব, ছেলের বাপের উন্নাসিকতা, আমাদের সন্তানদের পথ হারিয়ে বরবাদ হয়ে যাওয়ার কথা আছে মনিরুল ইসলামের লেখনীতে। রয়েছে থ্রিল- রোমান্টিকতাও ।
মনিরুল ইসলাম পেশাদার লেখক নন। তিনি একজন উর্ধ্বতন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা। তবে পেশাগত কাজের ফাঁকে লেখালেখির চর্চা রয়েছে নিয়মিত। নিয়মিত লেখালেখি করেন বলে এমন জাত লেখকের ছাপ কী করে এলো তার মধ্যে? প্রশ্নটা সামনে আসাই স্বাভাবিক। ২৮/২৯ বছরের চাকরিতে তার বেশিরভাগ কাজই হয়েছে সাদা পোশাকে। পুলিশের পাশাপাশি সমাজের ভেতর-বাইরও বেশি করে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান পদটির অভিষেক তাকে দিয়েই শুরু হয়। পাঁছ বছরের কর্মকালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান সাফল্য পায় তার সরাসরি নেতৃত্বে। দীঘদিন গোয়েন্দা শাখা ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের দায়িত্ব পালনকালে বহু সন্ত্রাসীকে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদের কাজটি করেছেন তিনি। এ অভিজ্ঞতা তাকে ঋদ্ধ করেছে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ সম্পর্কে। দিয়েছে বাড়তি অন্তর্দৃষ্টি। তা আরো ঝালাই করেছেন সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখিতে।
গল্প তৈরির নানা কলাকৌশল অবশ্যই রয়েছে। রয়েছে সেই কৌশল রপ্ত করার স্টাইলও। কিন্তু চাইলেই যে কেউ তা পারে না। একজন আরেকজনকে শেখাতেও পারে না। নিজের ভেতর সেই মোহ-আগ্রহ থাকতে হয়। কানাডা প্রবাসী আবু মুস্তাকিম ব্যক্তি জীবনের একরাশ হতাশা নিয়ে দেশে ফিরে আসাকে উপলক্ষ করে মনিরুল ইসলাম যেভাবে তার ‘পথভোলা পথিকেরা’ উপন্যাসটির রচনা টেনে নিয়েছেন যা নিঃসন্দেহে একটি স্টাইল। লেখক জীবনের অন্যতম দিক এটি। অনেক বড় বড় লেখকের জীবনেও স্টাইল তৈরির সৌভাগ্য হয় না।
তার গল্পের প্রবাস ফেরত মুস্তাকিম হতাশ হলেও স্বপ্ন হারাননি। তার স্বপ্ন ছিল এক অলৌকিক সমাজ গড়ার। সমাজের লৌকিকতার মাঝে শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশে থাকা পুরনো ইসলামী উগ্রপন্থিদের সঙ্গে কিভাবে তার যোগাযোগ হয়. এর কিঞ্চিত বর্ণনা আছে লেখায়। রয়েছে আরো অনেক কথা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানে দেশে থাকা উগ্রপন্থিরা ছিল চরম বিপর্যস্ত। তারা স্বপ্নবাজ আবু মুস্তাকিমের মধ্যে নতুন ধরনের আশার আলোর খোঁজ পায়। তার নেতৃত্বে তারা এগিয়ে চলে। সংগঠনে অল্পদিনে নতুন নতুন মুখ যোগ হয়। সংগঠনের পুরনো নেতা আবু দুজানা দেখে সুদূর কানাডা থেকে আসা আবু মুস্তাকিম আশ্চর্যজনকভাবে নিজের ব্যক্তি কারিশমায় ‘জিহাদি’ হিসেবে ধনী লোকের ছেলেদের সংগঠনে যুক্ত করছে। তার একটু ঈর্ষাবোধ হয়। তবে কি সে নিজের সংগঠনের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে না? নিজের ভাবনা সে প্রকাশ করে না। কারণ তার জানা আছে আবু মুস্তাকিমের গোপন দুর্বলতা। তাছাড়া নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সে বোঝে আবু মুস্তাকিমের সঙ্গে এখনই দ্বন্দ্বে জড়ালে সংগঠনে ধ্বংশের ঝুঁকি দেখা দেবে। শুরু হয় এক অপারেশনের প্রস্তুতি যা বদলে দেবে বাংলাদেশের চেহারা। কোথায় কী সেই অপারেশন? গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি পারবে আবু মুস্তাকিমকে ঠেকাতে? রোমহর্ষক এ আখ্যানের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে টান টান উত্তেজনা। এসবের বিস্তারিত জানতে উপন্যাসের শেষ পাতা অবধি টেনে নেবে পাঠককে।
ভালো লেখক হতে গেলে সবার আগে নিজেকে ভালো পাঠক হতে হয়। নতুন-পুরোনো, জীবিত- মৃত লেখকদের লেখা থেকে শুরু করে মুদি দোকানের ঠোঙা পর্যন্ত সবকিছু গোগ্রাসে পড়ে ফেলার নেশা অনেক লেখককে জীবনী দিয়েছে। মার্কিন লেখক জোনাথন লেথেম বলেছেন, একজন লেখককে হতে হবে তার সময়ের সবচেয়ে অগ্রসর পাঠক। আমাদের সৈয়দ শামসুল হক দাবি করেছেন, ক্ল্যাসিক লেখকদের লেখা পড়ে তিনি টের পেয়ে যান, ওই লেখক কোন অধ্যায়ের পর কোন অধ্যায় লিখেছেন, কোথায় কলম থামিয়ে ওই দিনের মতো বিরতি নিয়েছেন। মনিরুল ইসলাম নিশ্চয়ই এসব পাঠপঠন জানার বাইরে নন। আর স্টাইলটি তার নিজস্ব সৃষ্টি। তার বাড়তি আরো কিছু চর্চা ছিল। তা পড়াশোনার ক্ষেত্রেও। ১৯৭০ সালের ১৫ জুন গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া মনিরুল ইসলামের লেখাপড়ার চৌহদ্দীও বিস্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাড়িয়ে তার দিগন্ত আরো নানা দিকে।
২০০১ সালে সিএমপি এবং ডিবিতে এসি হিসেবে কাজ করার সময় থেকেই তার সাংবাদিকদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা । কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্তদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। এক পর্যায়ে ২০১০ সাল থেকে ডিএমপির মুখপাত্রের দায়িত্ব বর্তায় তার ওপর। পেশাগত এ দায়িত্বের সুবাদে মিডিয়া জগতের দিকপাল থেকে একেবারে নবীন সংবাদকর্মীর সাথেও যোগাযোগ হয়। যা পেশাগতভাবে তাকে সমৃদ্ধ করেছে।
সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে আত্মোৎসর্গকারী পুলিশ সদস্য ও সন্ত্রাসবাদের শিকার দেশি-বিদেশি নিরীহ মানুষকে উৎসর্গ করা ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে বর্ণবিন্যাসের প্রকাশিত বইটি পড়েছি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। শুধু পড়েই শেষ হয়নি। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে, আমাকে দুই দুইবার-( পথভোলা পথিকেরা,) বারবারই টেনে নিয়ে গেছে বইয়ের জালে জড়িয়ে আবদ্ধ করে নেয়।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বেড়ে ওঠা, সদস্য সংগ্রহ, পলাতক-ফেরারি জীবন, জীবনবাজী রেখে অভিযানসহ নানা পর্ব নানা নামে তুলে আনা বড় কঠিন কাজ। কেবল তিন’শ টাকা উশুল নয়, বইটি অনেক অজানা সম্পর্কে ধারনা দেবে, যা সচেন যে কারো জন্যই জরুরি।
লেখক : প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাপ্তাহিক বাংলাপোষ্ট

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন
© All rights reserved © dailyamarsomoy.com