বাংলাদেশে মৃত্যুর ৭১ শতাংশই এখন অসংক্রামক রোগজনিত-যার অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক শুধু ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না, বরং এটি দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট (বাটা)-এর আয়োজিত এক সভায় এই বাস্তবতা আবারও সামনে এসেছে। সভায় জানানো হয়, তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয় বছরে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এই অঙ্ক শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির নয়, এটি রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে-রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য নিয়ন্ত্রণে বাধ্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সাংবিধানিক দায়িত্ব বাস্তবে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। তামাকবিরোধী আইন থাকলেও এর প্রয়োগ দুর্বল। পাবলিক স্থানে ধূমপান, দোকানে তামাকজাত পণ্যের প্রদর্শন বা প্রচার-সবই এখনো স্বাভাবিক দৃশ্য। এর পেছনে প্রশাসনিক শিথিলতা, তামাক কোম্পানির প্রভাব এবং জনসচেতনতার ঘাটতি প্রধান বাধা। সভায় বক্তারা যথার্থই বলেছেন-তামাক নিয়ন্ত্রণকে কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হিসেবে দেখা উচিত নয়। বাণিজ্য, অর্থ, শিক্ষা ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ রাষ্ট্রের সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। কারণ তামাকের প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে-চাষ থেকে বিপণন পর্যন্ত-ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান গতি সেই লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। আইন সংস্কারে বিলম্ব মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলা। তামাকবিরোধী কার্যক্রমে স্থানীয় সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও প্রচারণার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণে নাগরিক সমাজ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা বাড়ানো সময়ের দাবি। তামাকবিরোধী আন্দোলনকে শুধু নীতিমালার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। স্কুল, কর্মস্থল ও গণপরিবহন-সব জায়গায় ‘ধূমপানমুক্ত পরিবেশ’ নিশ্চিত করা এবং তামাকজাত পণ্যের বিক্রি সীমিত করা জরুরি। তামাকের বিরুদ্ধে লড়াই কোনো এক দিনের কাজ নয়; এটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়। এখন সময় এসেছে কথায় নয়, কাজে দেখানোর-তামাক নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র সত্যিই কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
Leave a Reply