1. : admin :
অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট এর সংবাদ সম্মেলন - দৈনিক আমার সময়

অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট এর সংবাদ সম্মেলন

মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু
    প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪

”অগ্নি নিরাপত্তা ও জীবনের সুরক্ষা” সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বেইলি রোডের গ্রীন কোজি কটেজ শপিং মলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহতদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউটের গভীর সমবেদনা এবং দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্যলাভ কামনা করছে । তাঁরা আশাবাদী যে, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং সংশ্লিষ্ট সকল দায়ী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই অগ্নিকান্ডের পরের দিন সকালেই বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউটের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধিদলে উপস্থিত ছিলেন বাস্থই সভাপতি, সহ-সভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি), সাধারণ সম্পাদক, সহ-সাধারণ সম্পাদক ও সম্পাদক (সদস্যপদ)। জননিরাপত্তার স্বার্থে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার ইতোমধ্যেই একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যার মাধ্যমে দেশবাসী এই ঘটনার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত হবে বলে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট আশাবাদ ব্যক্ত করছে।

বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় সংগঠন যা দেশের পেশাজীবী স্থপতিদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে প্রয়োজনীয় সহায়তাও প্রদান করছে। বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট, এই দুর্ঘটনার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা বৃদ্ধির উপায় সম্পর্কে জনসাধারনের অবগতি ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেবা প্রদানের লক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে বাস্থই’র পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বাস্থই সভাপতি স্থপতি প্রফেসর ডঃ খন্দকার সাব্বির আহমেদ,সহ-সভাপতি(জাতীয়বিষয়াদি) স্থপতি প্রফেসর মুহাম্মদ আলী নকী,সহ-সভাপতি (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) স্থপতি খান মো: মাহফুজুল হক,
সাধারণ সম্পাদক স্থপতি নবী নেওয়াজ খান, সম্পাদক (পেশা) স্থপতি মো: নাজমুল হক বুলবুল এবং সম্পাদক (পরিবেশ ও নগরায়ন) স্থপতি সুজাউল ইসলাম খান সহ অন্যান্য নির্বাহী পরিষদ সদস্যগণ।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট ভবন নির্মাণের জন্য প্রণীত ”ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮” ও ”বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০” প্রণয়নের কার্যক্রমের অন্যতম সক্রিয় অংশীজন এবং বর্তমান ”ড্যাপ ২২-৩৫” এর প্রয়োজনীয় সংস্কারে সচেষ্ট।
বেইলি রোডের গ্রীন কোজি কটেজ শপিং মলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে প্রাথমিকভাবে নিম্নের পর্যবেক্ষনগুলো বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করছেঃ০১. অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ ভবনটির নির্গমন পথ বাধা মুক্ত ছিল না বলে প্রতিয়মান হয়। বিশেষ করে সিঁড়িগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার এবং অন্যান্য মালামাল সংরক্ষিত ছিল।
০২. ভবনটির সিঁড়ির ফায়ার রেটেড ডোর পরিলক্ষিত হয়নি। এর ফলে অগ্নিকান্ডের ধোঁয়া অতি দ্রুত এক ফ্লোর থেকে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
০৩.প্রাথমিকভাবে অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত ঘটে ভবনের নিচতলার পশ্চাত অংশে, যেখানে দমকল বাহিনীর কর্মীরা সহসা পৌঁছাতে পারেন নি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে অগ্নিনির্বাপন করতে সক্ষম হননি। আরও উল্লেখ্য যে, ভবনের নিচতলার পশ্চাত অংশে কোন নির্গমন পথ ছিল না।
০৪. ভবনটিতে অগ্নিপ্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সনাক্তকরন এবং অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা ছিল খুবই অপ্রতুল।
০৫.ভবনটিতে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থাপনা যথাযথ ছিল না।
০৬.ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছিল কিনা কিংবা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া হয়েছিল কিনা তা তদন্তের দাবী রাখে।
এই মর্মান্তিক ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে করণীয় বিষয়সমূহ:
০১. আইনী কাঠামো এবং আইনের প্রয়োগঃ
বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট, অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে, ইমারত নির্মান বিধিমালা ২০০৮, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ এবং বাংলাদেশ অগ্নিনিরাপত্তা আইন ২০১৪ তে দেওয়া আইনগুলো পর্যবেক্ষন করে এই অভিমত দেয় যে, এই তিন সূত্রে উল্লেখিত আইনসমূহ জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
০২.ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন বিষয়ে:
একটি ভবনের আয়ু সাধারনতঃ ৫০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়। ভবনের আয়ুষ্কালে শহর ও সমাজের পরিবর্তন অতি স্বাভাবিক, তাই ভবনের অনুমোদিত ব্যবহারও বদলাতে পারে। অতি দ্রুত বর্ধনশীল, ঘনবসতিপূর্ন এই নগরে প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিসর এবং চিত্তবিনোদনের সুযোগ অতি সীমিত যা ভবনগুলোর ব্যবহারের উপর প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতিতে ভবনের ব্যবহার পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। বিদ্যমান আইনের সাথে সমন্বয় করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ঢাকায় কোন ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন করার জন্য বিভিন্ন সরকারী সংস্থার অনুমতি প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইত্যাদি রয়েছে। প্রয়োজনে ভবন ব্যবহার পরিবর্তন করার পদ্ধতিটি Digital করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
তবে কেন এসব দুর্ঘটনা ঘটছে?
ক) ভবনের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা ও নানাবিধ ভোগান্তি আইন মানতে জনসাধারণকে নিরুৎসাহিত করে।
খ) সংস্থাগুলোর কর্মকান্ডে সমন্বয়ের অভাব।
গ) ব্যবহার পরিবর্তনের সময় উপযুক্ত পরামর্শক নিয়োগ না করা।
আশার কথা রাজউক সম্প্রতি Electronic Construction Permitting System (ECPS) এর মাধ্যমে এই পরিস্থিতির অবসান করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
০৩.ভবনের অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তা কৌশলের ব্যবহারঃ
বর্তমানে অগ্নিনিরাপত্তা কৌশল নির্ধারণ একটি অত্যন্ত পরিশীলিত বিজ্ঞান। একটি ভবনে ব্যবহৃত নির্মাণ উপকরনের দাহ্যতা সম্পর্কে তথ্যাদি Material Safety Data Sheet এর মাধ্যমে স্থপতি, প্রকৌশলী এবং সকল অংশীজন অবগত থাকেন। প্রতিটি ভবনের ধারন ক্ষমতা অনুযায়ী Life Safety Plan বা জীবন রক্ষা নকশাও করা হয়। অগ্নি নিরাপত্তার জন্য ভবনের ধারন ক্ষমতা, ব্যবহারের প্রকৃতি অনুযায়ী পৃথকীকরণের জন্য ভবনে ব্যবহৃত নির্মান উপকরনের দাহ্যতা বিবেচনা করা হয়। তবে আমাদের দেশে এসবের অনেক কিছুই বেশ ব্যয়বহুল। কিছু নির্মাণ উপকরনের Material Safety Data Sheet ও অনুপস্থিত। অতি ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরের সু-উচ্চ ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এসব উপকরনের সাশ্রয়ী মূল্য ও মান নিয়ন্ত্রন প্রয়োজন। ফায়ার সার্ভিস সহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতা এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এখন অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে।
০৪. NFPA এর সূত্রমতে পৃথিবীর ৫৩% অগ্নিকান্ডের সূচনা কিচেন বা রান্নাঘর থেকেই হয়। একে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। রান্নাঘরের ব্যবহার গুলোকে কম্পার্টমেন্টালাইজড করে ধোঁয়া, আগুন ও ক্ষতিকর গ্যাসকে সীমাবদ্ধ করা যায়। এছাড়া কমার্শিয়াল কিচেনের জন্য আলাদা অনুমোদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
০৫.অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বছরে একাধিক নির্দিষ্ট দিনে শহরের সকল ভবনে ফায়ার ড্রিল করা, অগ্নিদুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কমিউনিটি ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন এবং মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমে এ সম্পর্কিত অধ্যায় সংযোজন করা যেতে পারে।
০৬.অগ্নিনিরাপত্তায় ব্যবহৃত আমদানিকৃত উপকরনের শুল্ক ও কর সর্বক্ষেত্রে কমানো, মূল্য নির্ধারন করা এবং দেশী শিল্পখাতকে তা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনে প্রনোদনা দেয়া যেতে পারে। ভবনে ইন্টেরিয়র ডিজাইনে যে সকল নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয় তা কতটুকু ফায়ার রেটিং সম্পন্ন তার বিস্তারিত তথ্য ঐ নির্মাণ সামগ্রীসমূহে উল্লেখ করার জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং আমদানীকারকদেরকে নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
০৭.বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট মনে করছে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং পেশাজীবি ইনসটিটিউট এর অংশীজনদের সমন্বয়ে ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করার এখনই উপযুক্ত ও সঠিক সময়।
০৮.রাজউক এলাকাসহ সারাদেশে স্থপতিদের স্বাক্ষর জাল করে নকশা অনুমোদন করার বিষয়টি মহামারী আকার ধারণ করেছে। নকশা প্রণয়নের ন্যূনতম যোগ্যতা নেই – এমন অসাধু চক্র এই কাজে জড়িত। ফলস্বরূপ বিপুল, মতান্তরে অধিকাংশ ভবন অনুমোদিত হচ্ছে যার নকশা প্রকৃতপক্ষে এমন ব্যক্তির দ্বারা প্রণীত, যার অগ্নি নিরাপত্তা ও জীবন সুরক্ষা বিষয়ে ন্যূনতম কোন জ্ঞান নেই। অতিসত্ত্বর এই অসাধু চক্রকে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া স্থপতি আইন বা Architects Act প্রণয়ন করতে হবে।
০৯.বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থা এবং জনগনের সাথে যুগপৎভাবে কাজ করতে আগ্রহী যেন এই মর্মান্তিক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এ লক্ষ্যে ইনসটিটিউট যে কোন ধরনের ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনসেবামূলক পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি হেল্পডেস্ক খোলার উদ্যোগ নিয়েছে। ভবনের মালিকগণ এই হেল্পডেস্ক থেকে ইনসটিটিউটের কাছ থেকে প্রাথমিক পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন। বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেছে যে যথাযথ নিয়মানুযায়ী ভবন নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা করে ভবিষ্যতে এই জাতীয় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা রোধে সকলে সচেষ্ট থাকবেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন
© All rights reserved © dailyamarsomoy.com