বঙ্গবন্ধু চিরজীবন গণমানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। লড়াই করেছেন বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে।
জাতি রাষ্ট্রের মহান স্রষ্টা, বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমস্ত জাতির।
আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। কিন্তু আরব দেশগুলোর ওপর বিভিন্ন বিষয়ে নির্ভরশীলতার কারণে আলজেরিয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানে বিলম্বিত করেছিল।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে এবং ১৬ জুলাই স্বীকৃতি দান করে। একই বছরের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় রাষ্ট্র আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে স্বাধীনতার মহান স্হপতি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশ বিমানে তাঁর প্রতিনিধিদলসহ আলজিয়ার্স নগরীতে পৌঁছান, তখনো সম্মেলন শুরু হতে একদিন বাকি।
এর মধ্যেই রাজধানী আলজিয়ার্স এক উৎসবমুখর নগরীতে পরিণত হয়েছিল। প্রতি ঘণ্টায় বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের ভিআইপিরা এসে অবতরণ করছিলেন।
বিমানবন্দরে উড়ছিল বাংলাদেশসহ ৯২টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় পতাকা। বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে প্রেসিডেন্ট বুমেদিন খুবই আনন্দের সাথে সংবর্ধনা জানান বাংলাদেশের জাতির পিতা, বিশ্ববন্ধু, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
পরদিন স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিগুলোর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বুমেদিনের কোলাকুলির ছবি প্রাধান্য পেয়েছিল।
আলজিয়ার্স নগরীর উপকণ্ঠে এক বিশাল কনফারেন্স হলে নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই মোট ৯২টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রশাসনিক প্রধানরা এসে পৌঁছেছিলেন।
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, যুগোশ্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল, মরক্কোর বাদশা হাসান, ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট হাবিবরগুইবা, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্ত, কাম্পুচিয়ার প্রিন্স রাদম সিহানুক, নাইজেরিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা, উগান্ডার ইদি আমিন, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, নেপালের রাজা বীরেন্দ্র, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক প্রমুখ।
এ এক অবিশ্বাস্য ধরনের নিরাপত্তা বলায়ের মধ্য দিয়ে তিন ধরনের পরিচয়পত্র দেখিয়ে কর্মকর্তাদের যথাসময়ে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করতে হয়েছিল।
কনফারেন্স হলের অদূরেই আলজেরিয়া বিমানবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে একটি রানওয়েতে তিনটি মিগ যুদ্ধ-বিমান স্টার্ট নিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্বে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়াও হলের সামনে হেলিপোর্টে সবসময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল আরো তিনটি হেলিকপ্টার।
সম্মেলনে যোগ দেওয়া কোনো ভিভিআইপিকে ইসরায়েলি কিংবা অন্য কারো অপহরণের সম্ভাব্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার লক্ষ্যে এই অতিরিক্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা।
সম্মেলনের শুরুতেই বিভিন্ন দেশের নেতাদের পরিচয় করিয়ে দেন সম্মেলনের সভাপতি ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন। একজন করে নেতা মঞ্চে এসে দাঁড়ানোর পর প্রেসিডেন্ট বুমেদিন ছোট্ট বক্তৃতায় তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। সাথে সাথে হলে উপস্থিত সকল প্রতিনিধি করতালি দিয়ে উষ্ণ অভিনন্দন জানান।
পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের পরিচিতির সময় করতালি দীর্ঘস্থায়ী হয়। তবে স্বাধীনতার মহানায়ক, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতির সময় সম্মেলন কক্ষে অবতারণা হয় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাঙালি পোশাকে শ্বেতশুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরিহিত প্রায় ছয় ফুটের এক হিমাচল সদৃশ্য ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । মুখে শিশুর হাসি। সম্মেলন কক্ষের প্রতিটি মানুষ আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে চলছিল, সে করতালি যেন আর থামার নয়। এভাবেই সেদিন বিশ্বনেতারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান প্রাণঢালা ভালোবাসা এবং হৃদয়ের নিগড়ানো সংবর্ধনা। তিন মিনিটের বেশি সময় ধরে করতালির পর প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের ইশারায় সবাই আবার আসন নিয়েছিলেন।
বিশ্ববন্ধু, বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ব্যক্তিত্ব এবং সৎ সাহসে বিশালতায় আকাশসম।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এটি তাঁর মুসলিম বিশ্বের প্রতি পররাষ্ট্রনীতির একটি মাইলফলকও বটে।
এ সম্মেলনে বিশ্বের শান্তি আন্দোলন এবং পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক জোটের বাইরে একটি শক্ত জোরালো নিরপেক্ষ অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুসলিম বিশ্বের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন।
পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচারণায় মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম বিশ্বের নেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও ধারণা প্রদান করেন। এ সম্মেলনের পরপরই অনেক মুসলিম দেশ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক দুটি রাষ্ট্রের বন্ধুত্বকে আরো সুদৃঢ় করে।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির(OIC) সম্মেলনে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে বুমেদিন মধ্যস্থতা করেন।
বুমেদিনের সৌজন্যে ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২২ জন প্রতিনিধি নিয়ে আলজেরিয়ার বিশেষ বিমানে লাহোরে ওআইসির(OIC) সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের পরেই ১৯৭৪ সালের ৮ মার্চ বুমেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফর করেন।
উল্লেখপূর্বক বলতে হয় জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সরকার প্রধানদের সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা ত্যাগ করবেন বলে জানানো হয়েছিল । আলজিয়ার্সের প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন। এই আমন্ত্রণ আগের দিন এসে পৌঁছায়।
৫ সেপ্টেম্বর সরকার প্রধানদের সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এনায়েত করিম, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক ওবায়দুল হক এবং জনপদের সম্পাদক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
এছাড়া একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল সংবাদ সংগ্রহের জন্য আলজিয়ার্স গিয়েছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য শামসুল হক এমপি পূর্বেই আলজিয়ার্সে অবস্থান করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন মিসরে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুর রহমান ও সেনেগালে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল হক।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে শোষণমুক্ত সমাজবাদী সমাজ গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টায় দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন । শীর্ষ সম্মেলনে অন্যান্য বিশেষ বিষয়ের সঙ্গে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য এবং ভারত মহাসাগরকে যুক্ত এলাকায় পরিণত করার প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনা করেন । এই দুটি বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের মতোই বলিষ্ঠ অভিমত প্রকাশ করেন।
ব্রাজিলে সফররত পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আলজিয়ার্সে যাবেন বলেও জানানো হয়েছিল । প্রসঙ্গত, ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্দোনেশিয়ায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বাংলাদেশকে জোটনিরপেক্ষ জাতিগোষ্ঠীর সদস্যভুক্ত করার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী ও শান্তিপ্রিয় জনগণ এতে অত্যন্ত আনন্দিত।’ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ নীতির একনিষ্ঠ অনুসারী এবং বাংলাদেশ পৃথিবীর দেশগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী।’
তিনি বলেন, ‘জোটনিরপেক্ষতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং এ নীতি বিশ্বশান্তি আন্দোলনকে জোরদার করবে।’
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আরো গতিশীল ও দক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে, এই আশা নিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক আলজিয়ার্স নগরীতে চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে আফ্রো-এশীয় শীর্ষ সম্মেলনের জন্য যে ভবন নির্মিত হয়েছিল, সেখানে পৃথিবীর ৬০টি দেশের রাজা, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মিলিত হবেন কখনও গোপনে, কখনও প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলবেন।
উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালের আফ্রো-এশীয় সম্মেলন শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এবারের সম্মেলন দুই বছর আগে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্মলাভকারী নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাবে। সম্মেলনে কর্নেল গাদ্দাফির মতো বিতর্কিত নেতার উপস্থিতি বৈচিত্র্য আনবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
আলজিয়ার্সে চলতি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন বিদেশি সম্পত্তি ও বিদেশি পুঁজি রাষ্ট্রায়ত্ত করার সার্বভৌম ক্ষমতা চেয়ে আলজিয়ার্স প্রস্তাব পেশ করছে। তার ফলে সম্মেলনের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়া একটি অর্থনৈতিক গুরুত্বের পথ খুলে যাচ্ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকার নতুন পর্যালোচনা কূটনৈতিক মহল অনুভব করছে। বস্তুত আলজিয়ার্সের অর্থনৈতিক প্রস্তাব গত বছর অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সম্মেলনের চেহারা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক চেহারা দিলো।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদানকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এদিন (৪ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ, ভুটান, আর্জেন্টিনা, মালটা, ওমান, কাতার, পেরু ও মেক্সিকোকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যুক্ত করে। সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একঘণ্টা বিতর্কের পর শীর্ষ সম্মেলনের আলোচ্যসূচি গ্রহণ করেন। শীর্ষ সম্মেলন ৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা। সকালের অধিবেশনের আগে আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে একটি পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।
১৯৭৩ সালের জোট নিরপেক্ষ ন্যাম সম্মেলন। ভেন্যু আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইট থেকে নেমে টারমাকে পা দিলেন বিশাল দেহের এক মানুষ, সারা বিশ্বের অবিসাংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর তাঁকে রিসিভ করতে সব ধরনের প্রটোকল ভেঙে দাঁড়িয়ে আছেন আরেক দেশের এক রাষ্ট্রপ্রধান।
কোনো প্রটোকল মানেননি তিনি। স্বাভাবিকভাবে লম্বা মানুষটির জন্য আসার কথা আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। সর্বোচ্চ হলে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের।
কিন্তু এলেন একটি ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। ভিন্ন দেশের সে রাষ্ট্রপ্রধানের নাম জোসেফ ব্রোজ টিটো। আর লম্বা মানুষটি হলেন একটি দুই বছর বয়সী শিশু রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান—নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনটি দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন টিটো। সমীহ জাগানিয়া সেই বাহিনীগুলো হলো—অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, রাশিয়ান লালফৌজ আর যুগোশ্লাভিয়ান সেনাবাহিনী।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আর উত্থান-পতনের খরস্রোতের ভ্রুকুটি অস্বীকার করে গড়েছেন বিপ্লবী সরকার। পুরো জীবনই পরিচিত ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাটিতে নামতেই তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন টিটো। চোখ অশ্রুসজল। দুটো মানুষ কখনোই একে অপরকে দেখেননি।
কিন্তু তারা যেন আত্মার আত্মীয়। পৃথিবীর দুই প্রান্তের, দুই অঞ্চলের, মেরুব্যবধানে অবস্থিত দুই সংস্কৃতির জনমানুষের নেতা তারা।
ঐ মুহূর্তে মুখোমুখি দাঁড়ানো এই দুই রাষ্ট্রপ্রধানের পেছনে পড়ে আছে ভয়াবহ বিরুদ্ধ স্রোত মোকাবেলার দীর্ঘ ইতিহাস। তাই অভিজ্ঞতার এক অভিন্ন ছাঁচে তারা একে অন্যকে চিনে নিতে পারেন, সেই জেনে ওঠা যেন ইতিহাসের নিজস্ব দ্বন্দ্ব—শোষিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকেও উৎসারিত।
১৯৭৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে বার্তা সংস্থা তাসকে টিটো বলেছিলেন, “আমি শেখ মুজিবকে দেখিনি আগে। তাঁর সঙ্গে আমার যোগসূত্রগুলো ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, কিছু চিঠিপত্র, লালফাইল বগলে নিয়ে কার্যালয় প্রদক্ষিণ করা আমলার দল আর লাল রঙের একজোড়া টেলিফোন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আত্মার আত্মীয় ছিলাম। কারণ আমাদের স্বপ্ন ছিল এক। আমরা বৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভালোবাসাময় সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম। শোষণমুক্ত ব্রহ্মাণ্ডের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা এজন্যই আত্মার আত্মীয়।”
মার্শাল টিটোর একটি বড় দুর্নাম ছিল। তিনি অত্যন্ত কঠোর হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তাঁকে অশ্রুসজল অবস্থায় কেউ কখনো দেখেননি। শুধু আলজিয়ার্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সেই টারমাক ছাড়া।
টিটো সেখানে সেদিন কেঁদেছিলেন। কাছের মানুষকে কাছে পাবার আনন্দের অশ্রু। সেবারের ন্যাম সম্মেলন ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বনেতাদের পরিচিতির সম্মেলন। এই সম্মেলনে একটি দেশের নেতা বঙ্গবন্ধু পা বাড়ালেন আন্তর্জাতিক পরিসরে।
তাঁর সঙ্গে সেই সম্মেলনে দেখা হয়েছিল ফিদেল ক্যাস্ট্রো, লি কুয়ান আর গামাল আব্দুল নাসেরের মতো নেতাদের। প্রবল মেরুকরণের যুগে যারা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশকে সেই স্রোতে গা ভাসানো থেকে দূরে রেখেছিলেন। রচনা করছিলেন একের পর এক রাজনৈতিক মহাকাব্য।
জোসেফ মার্শাল টিটো তাঁর আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুকে তিনি সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, তারা বড় অনেকগুলো দেশের চক্ষুশূল। তাই সাবধানে থাকাই শ্রেয়। বরাবরের মতোই বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে হালকাভাবেই নিয়েছিলেন।
জোট নিরপেক্ষ দেশের অধিকাংশ নেতাই একাধিকবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছেন একবার। সে একবারেই তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
কারণ বঙ্গবন্ধু একটিবারের জন্যও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেননি। নিজের দেশের মানুষকে তিলমাত্র অবিশ্বাস করতে চাননি।
১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ আমার শক্তি এটাই যে আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি। আর আমার দুর্বলতা, আমি এদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ‘
১৯৭৩ সালের ২৩ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এশিয়া শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ এই অস্ত্র প্রতিযোগিতার চক্রধারায় জড়িয়ে পড়েছে ছোট, বড়, মাঝারি অনেক দেশ। ফলে নানাভাবে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাজেট হচ্ছে স্ফিত। এই অবস্হার অবসান আমাদের একান্ত কাম্য। আমরা চাই অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক। ‘
তিনি আলজিয়ার্স সম্মেলনে বলেছিলেন,’ বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক এবং শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে। ‘
জোসেফ মার্শাল টিটো নিজেও একাধিকবার হত্যার শিকার হতে পারতেন। সাবধানতা তাঁকে রক্ষা করেছিল।
ন্যামের জন্ম হয় ১৯৬১ সালে টিটোর নিজ শহর বেলগ্রেডে। টিটোই ছিলেন সংগঠনটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক। এই সংস্থা গঠনের পেছনে ছিলেন তিনজন মানুষ। যুগোস্লাভিয়া থেকে টিটো, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের (মিসর ও সিরিয়া) গামাল আব্দুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার আহমেদ সুকর্ণ, ঘানার কাওয়ামে ক্রুমাহ আর ভারতের জওহরলাল নেহেরু। নেহরু ছিলেন পাঁচশীল নীতির প্রবক্তা।
গত শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতি ছিল আপাদমস্তক ঘটনাবহুল। ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ ওই সময়টাতে ঘটে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং আরো বেশকিছু ঘটনা যা ভবিষ্যত বিশ্বের মোড় আমূল ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আর এই পটপরিবর্তনের মধ্যেই ন্যাম অনেক দেশের ঔপনিবেশিক কাঠামো ভাঙতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল।
এই আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য ছিল ১০টির অধিক দেশের স্বাধীনতা। এবং একইসাথে বিশ্বশান্তি রক্ষায়ও এই আন্দোলনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৯৫৫ সালের ১৮-২৪ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বান্দুং এশিয়ান-আফ্রিকান কনফারেন্স। সেই কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলেন ঔপনিবেশিক যুগপরবর্তী ২ মহাদেশের ২৯টি স্বাধীন দেশের নেতারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা বিবেচনা করে করণীয় ঠিক করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।
বান্দুংয়ের এই সভাটি থেকেই ন্যাম গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৬০ সালের শুরুর দিকে ন্যাম গঠন আরো একধাপ এগিয়ে যায় জাতিসংঘের ১৫তম সাধারণ অধিবেশনে।
সেখানে এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ১৭টি দেশকে নিয়মিত অধিবেশনে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়। এসবের নেপথ্যে কাজ করছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা জোসেফ ব্রোজ টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ঘানার কাওয়ামে ক্রুমাহ এবং ইন্দোনেশিয়ার আহমেদ সুকর্ণ।
এই পাঁচজন নেতার হাত ধরেই মূলত গড়ে ওঠে ন্যাম। পরবর্তীতে ন্যামকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত হয় ন্যামের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন। যেখানে অংশ নেয় ২৫টি দেশ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়াতে ন্যামকে কোনো সংগঠনের বদলে একটি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধরে রাখায় পরস্পরকে সংযোগিতা এবং শক্তিবৃদ্ধি করা, জাতিবিদ্বেষ দূরীকরণ, বৃহৎ শক্তির চাপে পরে বহুপক্ষীয় সামরিক চুক্তি করায় বাধ্য হওয়া থেকে রক্ষা করা, এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের অবরোধ হুমকিকে যৌথভাবে মোকাবেলা করা, এবং এর সাথে জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা ইত্যাদি ছিল ন্যামের প্রাথমিক লক্ষ্য।
তবে ন্যামের সর্বপ্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে আপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী সদস্য দেশগুলোকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখানো, বহির্শক্তির প্রভাব থেকে রক্ষা এবং দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্যদেশের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছিল, তাদের প্রতি প্রথম থেকেই সমর্থন প্রকাশ করে গেছে ন্যাম। পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর অধিকার নিয়েও সবসময় মুখর থেকেছে।
ন্যাম সম্মেলন প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী একবার নিজের স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, সেই সম্মেলনের কথা—“১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ‘জোটনিরপেক্ষ ৭৩ জাতি শীর্ষ সম্মেলন’ চলছে। বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। একটি স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একজন গণতান্ত্রিক নেতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন, সেই নেতাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন শীর্ষ সম্মেলনে আগত অন্যান্য নেতারা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলন কক্ষে ঢুকতেই অনেক নেতা তাঁর দিকে ছুটে আসেন। আমার সাংবাদিক জীবনের এটা সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের তখন চা-বিরতি হয়েছে।
রাষ্ট্রনায়করা একটা বিরাট হল ঘরে পানীয় হাতে পরস্পরের সঙ্গে গল্প করছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তাদের কয়েকজন গোল হয়ে দাঁড়ালেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এগিয়ে এসে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মিসরের আনোয়ার সাদাত, লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো ও কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো এবং এ বৃত্তের বাইরে, একটু বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল। সম্ভবত আরো দুয়েকজন ছিলেন। তাদের কথা মনে নেই।”
বঙ্গবন্ধুকে কোনো আঞ্চলিক রাজনীতিবীদ হিসেবে দেখার কখনোই সুযোগ নেই, কখনো ছিলও না। বঙ্গবন্ধু সেই নেতাদের অংশ ছিলেন, যারা পিছিয়ে পড়া একাধিক দেশের সাধারণ মানুষের স্বপ্ন দেখানোর কারিগর। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামনের সারিতে যেসব নেতারা ছিলেন, টিটো বাদে কারোরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।
সবার মৃত্যু হয়ছে ষড়যন্ত্রের জালে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাসে। ওই বছরেরই জুলাই মাসে হত্যা করা হয় সৌদি আরবের বাদশা ফয়সালকে। তিনি এক বছরের মধ্যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের দখলমুক্ত করে পবিত্র আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন।
তিনি তাঁর পরিবারের এক সদস্যের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন।
ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করে চরমপন্থি মুসলিম ব্রাদারহুডের জঙ্গিরা। যদিও বলা হয়, ইয়াসির আরাফাত রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন জানা যাচ্ছে, মোসাদের চরেরা তার শরীরে স্লো পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। আরব বসন্তের নামে হত্যা করা হয় লিবিয়ার গাদ্দাফিকে।
টিটোর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন সারথিদের সর্বাগ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধুই। তাকেই হত্যা করা হয় সবার আগে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতারা সারাবিশ্বের জন্যই আলোকবর্তীকার মতো। যারা বিশ্বকে শেকলবন্দী করে রাখতে চায়, বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য ছিলেন পথের কাঁটা।
যদিও ভিন্ন প্রসঙ্গ তবুও উল্লেখ করতে হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ২৮ জুন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্রোর বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে ভোজসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ প্রতিশোধ বা প্রতিষ্ঠানের যে মনোভাব থেকে সৃষ্টি ঘটনাবলির স্মৃতিচারণ আমার উদ্দেশ্য নয়। আমাদের বিপ্লবের অভিজ্ঞতা ও গতিশীলতা সত্ত্বেও আমরা সর্বদা প্রতিহিংসা পরিহার করে এসেছি। আমরা চেয়েছি ন্যায়বিচার, আমরা চেয়েছি সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তিতে এবং মর্যাদার সাথে সকল বিরোধের নিষ্পত্তি। এই উপ-মহাদেশের শান্তি স্হাপনের বৃহত্তম স্বার্থে আমরা নিষ্কণ্টক মর্যাদা কামনা করছি।
শান্তি যেমন আমাদের ঐকান্তিক কামনা, দুনিয়ার নির্যাতিত জাতি ও মানুষের সকল সংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থন তেমনি দ্ব্যর্থহীন। আমরা বিশ্বাস করি, উপ-মহাদেশের এবং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কোটি কোটি মানুষের কল্যাণের জন্য শান্তি ও সহযোগিতা একান্তভাবে অপরিহার্য।
এদেশের মানুষ একটি বৃহত্তম লক্ষ্য বা মাহাত্ম্যবোধ ও দেশের জন্য যে অকৃত্রিম ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে তা অতি বিরল। কিন্তু নিষ্পত্তি ও সমঝোতার স্হায়ী প্রচেষ্টা কখনো একতরফা হতে পারে না। সত্যিকারের নিষ্পত্তির স্বার্থে পাকিস্তানের জনগণ ও সরকারকে ১৯৭১ -এর সমস্ত সংঘাত থেকে উদ্ভূত অমীমাংসিত সমস্যাসমূহ আমাদের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হবে।
এই ভাগ্যাহত দুঃখী মানুষের সমস্যাটা একটা মানবিক সমস্যা। রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সুবিধাবাদের আদর্শে এই মানবীয় সমস্যাকে আমরা মিথ্যা হইতে দিতে পারি না। আমাদের দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পদ বাঁটোয়ারার প্রস্তুতি, আশু আলোচনা ও সমাধানের অপেক্ষা রাখে। ‘
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত এতো সৎ সাহসী, বলিষ্ঠনেতৃত্বগুণের অধিকারী নেতা পৃথিবীতে আর কোনোদিন আসবে না। তিনি সমস্ত পৃথিবীর মানবতার জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করেছিলেন।তাঁর দর্শন আজও পৃথিবীকে আলোকিত করছে। এই মহামানবের মৃত্যু নেই। তিনি অমর।তিনি অবিনশ্বর।
১৯৭৩ সালের ৩০ মে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে, উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন তা হুবহু তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি-
” একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা – অক্ষয় ভালোবাসা – যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। “
– এইচ এম মেহেদী হাসান
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সহ-সভাপতি – বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
Leave a Reply