একসময় শিশুর জন্ম, বিয়ে, জন্মদিন ও মুসলমানিসহ শুভদিনে সোনার অলংকার উপহার দেওয়া অনেকটাই রীতিতে পরিণত হয়েছিল। মধ্যবিত্তরাও বিশেষ অনুষ্ঠানে আংটি, গলার চেন, হাতের বালা অনেকটা হাসি মুখেই উপহার দিতেন। সোনার অস্বাভাবিক দাম হারিয়ে যেতে বসেছে সেই রীতি। দাম এতটাই বেড়েছে যে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকাতেও ছোটখাটো কোনো অলংকার পাওয়া যায় না। শুধু মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চবিত্তরাও অনেকে অলংকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একেবারে বাধ্য না হলে এখন কেউ সোনার অলংকার কিনছেন না। ফলে জুয়েলারি ব্যবসায় দেখা দিয়েছে মন্দা। এছাড়া বিশ্ববাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারে দাম বাড়ছে মূল্যবান ধাতু স্বর্ণের। তবে এমন বাড়তি দামে বিপাকে পড়েছেন দেশের অলংকার ব্যবসায়ীরা। ক্রেতাসংকটে বিক্রি কমেছে। এমনকি ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার কথাও ভাবছেন অনেকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আর অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সোনায় বিনিয়োগ বেড়ে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতেও সেটিই হয়েছে। এ কারণে বিশ্ববাজারে সোনার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ফলে দেশের বাজারেও দামি এ ধাতুটির দাম বেড়েছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে দামি এই ধাতুটি এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। বিক্রিও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। পাঁচ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে সোনার অলংকার বিক্রি অর্ধেকের নিচে। বিক্রি কমায় ব্যবসায়ীদের লাভও কমেছে। এখন বিক্রি যা হচ্ছে তা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ ও দোকান ভাড়া দিতে অনেক ব্যবসায়ীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হবেন। ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর জুয়েলারি ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। করোনা মহামারির মধ্যে আয় কমে যাওয়ায় অনেকে জমানো সোনা বিক্রি করেন। ফলে বছর দুয়েক আগেও সাধারণ মানুষ সোনা কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন বেশি। এখন সাধারণ মানুষ সোনার অলংকার যেমন কিনছেন না, তেমনি বিক্রিও খুব একটা করছেন না। এতে মনে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে সোনার অলংকার খুব একটা জমা নেই। দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। সবশেষ ২৩ অক্টোবর দেশের বাজারে স্বর্ণের নতুন দাম নির্ধারণ করে সংগঠনটি। তখন আরও এক দফায় প্রতি ভরিতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৯০ টাকা বেড়ে মানের তথা ২২ ক্যারেটের হলমার্ক করা এক ভরি সোনার দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৫১ টাকা। এটিই দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সোনার সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্যানুযায়ী, হলমার্ক করা ২২ ক্যারেট সোনার ভরি ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির পর হলমার্ক করা প্রতি ভরি ২১ ক্যারেট সোনা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫০১ টাকা ও ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ১৬ হাজার ১৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হচ্ছে ৯৫ হাজার ৪২৩ টাকায়। ১৯৭২ সালে সোনার ভরি ছিল ১৭০ টাকা। আর এখন ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৫১ টাকা। তার মানে গত ৫২ বছরে দাম বেড়েছে ৮৩৫ গুণ। এদিকে বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পাশাপাশি সোনার দামও পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। সোনার অলংকার এখন সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সোনার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় গয়না বিক্রি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ছোট ও হালকা ওজনের গয়না তুলনামূলক বেশি বিক্রি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে লেনদেন বেশি হলেও আগের চেয়ে পরিমাণের দিক থেকে সোনার গহনার বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে দুই মাস ধরে সব খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ। তার প্রভাব জুয়েলারি খাতেও ব্যাপকভাবে পড়েছে। এদিকে সোনার দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে সোনার বাজারে সুদিন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সোনার দাম বাড়তে থাকে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। তখন পর্যন্ত ওই দামই ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। গত বছরের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সোনার দাম ২ হাজার ডলারের মধ্যেই ছিল। গত বছর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর সোনার দাম আবার বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশেও উত্তেজনা ছড়ায়। গত সপ্তাহে লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সর্বশক্তি দিয়ে লেবাননে হামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় চলতি মাসেই প্রতি আউন্স সোনার দাম বেড়েছে পৌনে ২০০ ডলার। বিশ্ববাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার হ্রাসেরও ভূমিকা আছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট কমায়। ফলে সোনা কেনার দিকে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক আরও বেড়ে যায়। দেশের বাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধির আসল কারণ বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবান এই ধাতুর মূল্যবৃদ্ধি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার কারণে গত ফেব্রুয়ারি থেকে সোনার দাম দফায় দফায় বাড়ছে। এক মাস আগে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম বিশ্ববাজারে প্রথমবারের মতো আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ৭০০ ডলারের ছাড়িয়েছে।
Leave a Reply