ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সাধারণের প্রত্যাশা ছিল, মিলারদের চাল সিন্ডিকেট ভেঙে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে, মানুষ একটু সস্তায় চাল কিনতে পারবেন। কিন্তু মিলারদের সিন্ডিকেট এখনো রয়ে গেছে। ফলে পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ থাকার পরও দেশে গত এক মাস ধরে বাজারে প্রায় সব জাতের চালের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ত্রাণ বিতরণে মোটা চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। মাত্র সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৬ টাকা পর্যন্ত। জানা যায়, মোটা চালের ক্রেতার বড় অংশই এখন স্বেচ্ছাসেবীরা। বিতরণের জন্য বস্তায় বস্তায় চাল কিনছেন তারা। আর সে কারণেই বেড়ে গেছে পণ্যটির চাহিদা। আর এই বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে মোটা চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজিতে। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও, ৫০ কেজি বিআর-২৮ চাল মিলেছে ২৬০০ টাকায়। আর এখন তা কেনার জন্য গুনতে হচ্ছে ২৯০০ টাকা। বিক্রেতাদের দাবি, ত্রাণের জন্য মোটা চালের বাড়তি চাহিদা তৈরি হলেও, মিল থেকে পর্যাপ্ত চাল মিলছে না। তাই পাইকারিতে দাম বেড়েছে। গুটি, স্বর্ণা এবং বিআর-২৮ সহ সব ধরনের মোটা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য, বরাবরের মত, ধানের সংকটকে অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছেন মিল মালিকরা। সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরে মোটা চালের দাম ৫৬ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে এখনও চড়া দামে অপরিবর্তিত আছে মাঝারি ও চিকন চালের বাজার। নাজিরশাই ও মিনিকেটের মতো মাঝারি মানের চিকন চাল বাজারভেদে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় আর ৭৫-৮০ টাকা কেজির নিচে মিলছে না ভালো মানের চাল। জানা যায়, প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় মান ভেদে চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মিলারদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাজারে সরবাহ কম বলে দাম বাড়ছে এমন অভিযোগ পাইকারি ব্যবসায়ীদের। খুচরা বিক্রেতারা প্রতি কেজি নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, মিনিকেট ৬২ থেকে ৬৮ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করছেন। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৫ টাকা এবং মোটা হাইব্রিড প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়। এক মাস আগেও চালের দাম কেজি প্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা কম ছিল। এদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সড়ে চারশ’ চালকল রয়েছে। যার মধ্যে অটোরাইস মিলের সংখ্যা প্রায় ১০০। বৃহৎ এই মোকামের বেশ কয়েকটি চালের মিলে দেখা গেছে, মিল গেটে মিনিকেট চাল কেজি প্রতি ৬৭ টাকা, কাজললতা ৬১ টাকা, বাসমতি ৮৩ টাকা ও আটাশ ৫৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে কিছুকিছু ক্ষেত্রে চালের মানের ওপর নির্ভর করে দামওঠা নামা করছে বলে জানান মিলাররা। খুব ভালো মানের চাল একটু বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। আটাশ ধানের সরবরাহ কম থাকায় ও মূল্য বেশি হওয়ায় সবথেকে বেশি দাম বেড়েছে আটাশ চালের। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে চালের বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এ ছাড়া দেশের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যা কবলিত হওয়ায় ফসলি মাঠ তলিয়ে গেছে। সেজন্য চালের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়ছে বলেও জানিয়েছেন মিল মালিকরা। মিলে ধান সরবরাহকারী শাহজাহান মোল্লা জানান, গত ১ আগস্ট মণ প্রতি ১৪০০ টাকা দরে আটাশ ধান কিনেছিলেন তিনি। সেই একই ধান এখন ১৫০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ১০০ টাকা বেশি দরে ধান কিনতে হলে চালের দাম অবশ্যই বাড়বে। এদিকে রাইস মিল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ধানের দাম না কমলে চালের দাম কোনোভাবেই কমানো সম্ভব নয়। এজন্য কৃষক পর্যায়ে ধান উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে। ধানের বীজ, সার, বিদ্যুৎসহ উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রে খরচ কমাতে পারলে চালের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং রাইস মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, দেশের বড় একটি অংশ বন্যা কবলিত হওয়ায় চালের বাজারে বেশ প্রভাব পড়েছে। বন্যার পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এজন্য ফসল উৎপাদন অনেকাংশে কমেছে। তাছাড়া ধানের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। মিল গেটে জুলাই মাসের চেয়ে আগস্ট মাসে মোটা চাল কেজি প্রতি ৫ টাকা, মিনিকেট চাল ২ টাকা ও মাঝারি মানের চালের দাম ৩ টাকা বেড়ে যায় বলে জানান তিনি। তবে চালের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি দাবি করেন, এখানকার মিলগুলোর উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল। তবে সেসময় পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় বেশ কয়েক দিন মিল মালিকরা কুষ্টিয়া থেকে অন্য জেলায় চাল সরবরাহ করতে পারেননি। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণসহ ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন দেশের শীর্ষ এ চাল ব্যবসায়ী। বিগত করোনা কালের ধকল সামলানোর পর ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধ বিশে^র খাদ্য উৎপাদন, বিপনন ব্যবস্থায় পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ধাক্কা দিয়েছে। এর সাথে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার জনিত কারণে সৃষ্টি হয়েছে ডলারসহ বিদেশী মুদ্রামানের উল্লম্ফন। কমে গেছে টাকার মান। এর সাথে গলার কাঁটা হিসেবে মজুদদার সিন্ডিকেট এখনও অস্থির রেখেছে চালের বাজার। নতুন বিপ্লবী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত নিত্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে এমন দৃশ্যপট চোখে পড়েনি। তাই চালের বাজারে ইতিবাচক কোন প্রভাব পড়েনি। অভিযোগ রয়েছে ২/৩ টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ( যাদের অটো রাইস মিল রয়েছে ) এখন দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ধান উৎপাদনের উদ্বৃত্ত্ব অঞ্চল রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে অটোরাইস মিলের সংখ্যা এখন ৫ শতাধিক। এছাড়াও সেমি অটো হাস্কিং মিলের সংখ্যা কমবেশি ৪০ হাজার। এইসব মিলের উৎপাদিত চালের একটা অংশ অগ্রিম পেমেন্টে কিনে নেয় ২/৩ টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। ফলে চালের বাজারে অর্থনীতির স্বাভাবিক সরবরাহের কমবেশির ওপর মুল্য নির্ধারণ হয় না। চালের মুল্য নিয়ন্ত্রণ করে এ সিন্ডিকেট। সুত্র জানায়, আমন মৌসুমের অকালীন বন্যা এবার আমন চাল উৎপাদনে বিরাট প্রভাব পড়বে। ফলে আগামীতে চালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই সবকিছু পর্যালোচনা করে গোডাউনজাত প্রতিরোধ, ঋণ প্রবাহ চালু রাখাসহ বাজার মনিটরিং করলেই চালের বাজার স্থিতিশীল হয়ে আসবে।
Leave a Reply