আবহাওয়া ও জলবাযুর বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে দিন দিন বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। এর ফলে মানুষের সুপেয় পানির যেমন অভাব দেখা দিচ্ছে, তেমনি কৃষি ও মৎস্য চাষ চরম হুমকির মুখে পড়ছে। লবণাক্ততার ছোবলে কৃষি-অর্থনীতি, জীবন-জীবিকাসহ অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে নানামুখী সর্বনাশ। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনকে ‘রেড এলার্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের কর্মকান্ডের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে অপ্রত্যাশিত এবং অপরিবর্তনীয় উপায়ে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিতে পড়বে কোটি কোটি মানুষ। ২১০০ সালের মধ্যে ভেসে যাবে উপকূল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা প্রতিরোধে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যেমন কমাতে হবে, তেমনি প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। বর্তমানে দেশের উপক‚লবর্তী এলাকা ছাড়িয়ে এই লবণাক্ততা আক্রান্ত অঞ্চল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দক্ষিণ-পূর্বে টেকনাফ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণভাগে উপক‚লীয় তটরেখা ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের কোলে বিস্তীর্ণ চর-উপক‚ল-দ্বীপাঞ্চল। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, ল²ীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ ১৯টি উপক‚লীয় জেলার নদনদী খাল-বিল-খাঁড়ি, পুকুর-নলক‚পসহ পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপক‚লীয় এলাকার মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত কবলিত। এই লবণাক্ততার কারণে শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময়ে মাটির লবণাতক্ততা ৮.০ ডিএ/মি এর উপরে চলে যায়। এছাড়া এই সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫.০-৩০.০ ডিএস/মি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
লবণাক্ততা দিন দিন কৃষিজমি গিলে খাচ্ছে। জমি হারাচ্ছে উর্বরাশক্তি। ফল-ফসলের বর্ধন, ঘনত্ব বা নিবিড়তা এবং ফলন কমছে। খাদ্যনিরাপত্তা হচ্ছে বিঘিœত। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি-খামার এমনকি জনস্বাস্থ্য। বিষিয়ে উঠেছে পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য। একবার জমি লোনাক্রান্ত হলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন। প্রায় ৪ কোটি উপক‚লবাসী কোনো না কোনোভাবে লোনার শিকার। উৎপাদনশীলতা কমছে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় উপক‚লে। বেকার, স্থানান্তর ও পেশা বদল করছে মানুষ। প্রকট হচ্ছে দারিদ্র্য, আর্থ-সামাজিক সঙ্কট।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম এ প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। এরফলে অস্বাভাবিক সামুদ্রিক জোয়ারে নদ-নদী-খালের মিঠাপানি লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। মিঠাপানির মাছের বৃহত্তম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। কৃষিজমি লোনাকবলিত হচ্ছে। লবণ ও চিংড়ি চাষে রূপান্তরিত হচ্ছে ব্যাপক কৃষিজমি। তাছাড়া পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যের উপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। পরস্পর নির্ভরশীল জীবনচক্র ও খাদ্যশৃঙ্খল বিঘিœত হচ্ছে। অনেক প্রজাতির মাছসহ প্রাণিকূল, উদ্ভিদ বিলুপ্তির মুখে। লবণাক্ততার সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে।জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর প্রভাবে পৃথিবী এবং সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কক্সবাজার উপক‚লে বছরে ৭ দশমিক ৮ মিলিমিটার হারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। গত চার দশকে দ্বীপজেলা ভোলার প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের উপক‚লভাগে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ার এবং ছোট ছোট জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে ঘন ঘন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সিডর, আইলা, আম্ফান, ইয়াসের আঘাতে অধিকাংশ উপক‚লীয় জেলা-উপজেলায় বেড়িবাঁধ কমবেশি বিধ্বস্ত। ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ দিয়ে অবাধে জোয়ারের পানি ঢুকে ডুবছে অনেক এলাকা। উপরের দিকে স্থলভাগে ছড়িয়ে পড়ছে সামুদ্রিক নোনা পানি এবং কৃষি-অকৃষি জমি ও লোকালয়ে আটকে যাচ্ছে। গ্রাস করছে মিঠা পানি বা স্বাদু পানির নদ-নদী-খালসহ পানির যাবতীয় উৎস। উপকূলে নদ-নদী-খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে নোনা পানির প্রসার ঘটছে দ্রæত। লবণাক্ত পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভূগর্ভস্থ পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। ফল-ফসলের চাষযোগ্য জমিতে লবণাক্ততার হার বেড়েই চলেছে। আবাদী জমির পরিমাণ কমছে, বাড়ছে পতিত জমি। ফলনও হ্রাস পাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে সমগ্র কৃষি খাতে।দেশের আবাদী জমির ৩০ ভাগ উপক‚লীয় এলাকায়। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এবং লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের জরিপে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০০০ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ত জমি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। গত ৩৬ বছরে লবণাক্ত জমি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ দশমিক ৭ ভাগ। এরমধ্যে গত ১০ বছরে বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ।
গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী-খালগুলো প্রায় শুকিয়ে তলানিতে ঠেকে যায়। তখন উজানের দিক থেকে পানির স্বাভাবিক চাপ ও প্রবাহ থাকে না। অন্যদিকে নিয়মিত প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে ভরে যায় উপক‚লের নদ-নদী, শাখানদী ও খাল-খাঁড়িগুলো। সমুদ্রের নোনাপানি স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসে। অনেক নিম্নাঞ্চলে নোনাপানি আটকে থাকে। এরফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায়।তাছাড়া পদ্মা নদীর উজানে গঙ্গায় ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও পানির প্রবাহ আটকে রাখার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় ভাটিতে অবস্থিত অনেকগুলো নদ-নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এরফলে বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে লবণাক্ততা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে লবণাক্ততা বিস্তার লাভ করেছে ক্রমশ উজানভাগে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বৃহত্তর কুমিল্লা-চাঁদপুরসহ উত্তর দিকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত। নোনার আগ্রাসন আরও উত্তর দিকে বিস্তারের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।চট্টগ্রাম শহরতলীতে অবস্থিত ‘মৎস্য ব্যাংক’ খ্যাত এশিয়ায় জোয়ার-ভাটানির্ভর মিঠাপানির রুই-কাতলাসহ বড় জাতের (কার্প) মাছের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষিত হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক)। হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র প্রভাবে প্রবল জোয়ারের সাথে হালদা নদীতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অতিমাত্রায় অনুপ্রবেশ ঘটে। এর বিরূপ প্রভাবে মিঠাপানির রুই-কাতলা মা-মাছরা এবার (২৬-২৭ মে) ডিম ছেড়েছে সাড়ে ৬ হাজার কেজি। অথচ আগের বছর ২০২০ সালে একযুগের রেকর্ড ভঙ্গ করে ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম মিলেছে।
লোনার আগ্রাসনে সমগ্র উপক‚লে কৃষিসহ সবক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব দৃশ্যমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যশস্যের নিবিড়তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চল। দেশে ফসলের নিবিড়তা গড়ে ২শ’ ভাগ। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, লবণাক্ততার কবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষি-খামার, প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। তাছাড়া খাবারের জন্য মিঠাপানি এবং কৃষিজমিতে সেচের পানির সঙ্কট হবে আরও তীব্র। অনেক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ বিলুপ্তির পথে, আরও প্রজাতি হারিয়ে যাবে। তবে ২০৫০ সালের কথা ওই প্রতিবেদনে বলা হলেও সঙ্কট আরো দ্রত হচ্ছে। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্য মতে, দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে কৃষি-খামার ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে বর্তমানে বড় সমস্যার কারণগুলো হচ্ছে পানির উৎসগুলোতে এবং কৃষিজমিতে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা, লোনায় দীর্ঘ সময়ে পানিবদ্ধতা, সেচের পানিতে লবণাক্ততা। এতে করে অনাবাদী ও পতিত জমি বাড়ছে।লবণাক্ততা কবলিত উপক‚লে রোগব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বাংলাদেশের উপক‚লীয় এলাকায় ২০ শতাংশ প্রসূতি লবণাক্ততার কারণে অকাল গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন। গর্ভাবস্থায় অধিক মাত্রায় লবণাক্ত পানি পান করলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হার বেশি। আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লবণাক্ততার কারণে উপক‚লের মহিলারা অকাল গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন শুধু তাই নয়। একই কারণে তিন শতাংশ শিশু মারা যায়। তাছাড়া ডায়রিয়া, আমাশয়, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি বেশিমাত্রায় লক্ষ্য করা যায় উপকূলীয় অঞ্চলে।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। উন্মুক্ত জলাধার হ্রাস পাওয়ায় তাপপ্রবাহ বাড়ছে। এর প্রভাবে মানুষসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবধরনের প্রাণীরা। খুলনায় ১৩ হাজারের বেশি মুরগি মারা গেছে। তাপের কারণে ঘেরে চিংড়ি মরছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানি খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা জরুরি।
সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থায়ন ও সমন্বিত উদ্যোগ কৌশল শীর্ষক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানা গেছে। সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিশিষ্টজনরা অংশ নেন।
সভায় বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে খুব বেশি দায়ী না হলেও বাংলাদেশ অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় দিন বাস্তুহীন, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি ফসল, মৎস্য উৎপাদন কমছে। লবণাক্ততা বাড়ছে। খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশু স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
সভায় আরও বলা হয়, যে কোনও নীতিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিমত গুরুত্বপূর্ণ। ভুক্তভোগী ও সংকটাপন্ন মানুষ কীভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠবে বা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পেতে পারে তার সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। পরিবেশগত বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ কমানো, বৃক্ষরাজি গড়ে তোলা, নদী-খাল, হাওড়, বাওড়গুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশেষ অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা যথা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দেশী ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতিমালাগুলোর সমন্বয় করতে হবে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতনভাবে এসব কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে।
অ্যাওসেড’র উদ্যোগে কেয়ার বাংলাদেশের সহযোগিতায় ৩০ এপ্রিল বিকাল ৫টায় হোটেল ওয়েস্টার্ন ইন খুলনায় মাল্টি-অ্যাক্টর পার্টনারশিপ’স (এমএপি’স) অন ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইন্সুরেন্স (সিডিআরএফআই) প্রকল্পের আওতায় সিডিআরএফআই প্রচারের জন্য মাল্টি অ্যাক্টর প্ল্যাটফরম এর খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। সভায় সভাপতিত্ব করেন অ্যাওসেড’র নির্বাহী পরিচালক শামীম আরফীন। সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান।
আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা, কুয়েট ইউআরপি বিভাগের প্রধান ড. তুষার কান্তি রায়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান. খুলনা ওয়াসার প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জি এম মোস্তাফিজুর রহমান, মৎস্য দফতরের কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন, পানি অধিকার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির ববি, পরিবেশ দফতরের সহকারী পরিচালক মো. ইমদাদুল হক, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডেপুটি চিফ ড. মো. নজরুল ইসলাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি আসিফ আহমেদ, বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের মো. জুবায়ের হোসেন প্রমুখ।
আলোচনা সভা শেষে খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রশাসককে প্রধান করে একটি পরামর্শ কমিটি গঠন করা হয়। সভায় অংশ নিয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেটা আমরাও জানি, বিশ্ব নেতৃত্বও জানে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচা ও সুরক্ষা নিয়ে ভাবছি, পরিকল্পনা নিচ্ছি ও কাজ করছি। ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ৫৪টি নদীর ফয়সালা না হলে এর প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। পানিপ্রবাহ না থাকায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। আমরা কাজ করে এক ফসলির জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করছি। কিন্তু পানি সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। কারণ উজানের পানি নাই। সাগরের পানির ওপর ভরসা করায় লবণের মাত্রা বাড়ছে।’
সুন্দরবন সুরক্ষায় ঘষিয়াখালী খাল খনন করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যার সুফল এখন আমরা পাচ্ছি পুনঃখননের মাধ্যমে। ৫৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৩টি খাল খনন করা হয়। কিন্তু সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। নিয়মিত খনন করতে হয়। উজানের পানি প্রবাহ আনতে ৫৪ নদীর সমাধান দরকার।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি আছে কৃষি ও পানির ওপর। ফ্রেশ পানি হ্রাস পাওয়ায় মাছ চাষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব মারাত্মক। ফলে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদনও বাঁধাগ্রস্ত। বৃষ্টি কমছে। তাপমাত্রায় পরিবর্তন হয়েছে। মৌসুমি বৃষ্টি নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ছে। নওয়াপাড়া পর্যন্ত মিষ্টি পানি পাওয়া যেতো। এখন সেখানে লবণ পানি পৌঁছে গেছে। খাদ্য উৎপাদনের ওপরও প্রভাব দৃশ্যমান। যা উদ্বেগের বিষয়। মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মিটিগেশন ও অ্যাডাপটেশনের ওপর জোর দিতে হবে। সোসিও ইকোনমিক পলিসির ওপর পরিবর্তনের ওপর ফোকাস করে অ্যাডজাস্টের দিকে নজর দিতে হবে। ঝুঁকিগুলো শনাক্ত ও হ্রাস করার ওপর জোর দিতে হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কোন ফান্ড নেই। নিজস্ব উদ্যোগে পানি ব্যবস্থাপনায় কাজ করছি। আগে তদারকি করতেন খালাসী। তাই সমস্যা হলে দ্রুত কবর আসতো। এখন ব্যবস্থাপনা কমিটির করতে হয়। কিন্তু নজরদারি দুর্বল হওয়ায় খবর পেতে পেতে বাঁধ ক্ষতি হয়ে যায়। সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়।’
পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষ থেকে আসে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। এটাই আমাদের উদ্বেগের জায়গা। বায়ুমণ্ডলে কম কার্বন নিঃসরণ করতে হবে। পলিথিন উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ বেশি। আমাদের পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে ১০০ টন পলিথিন ব্যবহার হয়। যার ৫০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। আর বাকী ৫০ শতাংশ বাইরে থেকে আসে। এ ব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান, জেল জরিমানা করা হচ্ছে। পৃথিবী তার কক্ষপথ পরিবর্তন করলে জলবায়ু পরিবর্তন হবে। দশমিক ৭ শতাংশ কার্বনডাই অক্সাইড মনুষ্য সৃষ্ট কারণে হয়। যা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর তার সাধ্যমতো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। খুলনা অঞ্চলে তিনটি মনিটরিং কেন্দ্রে বায়ু দূষণ রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।’
প্রাণী সম্পদ বিভাগের উপ প্রধান কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তাপপ্রবাহে ব্যাপক ক্ষতি। ১৩ হাজারের ওপরে মুরগি মারা গেছে। প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। হিটের সময় ছায়া স্থানে রাখা ও তিনটার আগে মুরগীকে খাবার না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
কুয়েট অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. তুষার কান্তি রায় বলেন, ‘ময়ূর নদী ও ২২ খাল বেদখল। ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খনন কাজ চলছে। ওয়াকওয়ে করা, গাছ লাগানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্জ্য ও পলি অপসারণ করে খাল উদ্ধার করা প্রয়োজন। এখন কেবল শহরেই নয়। গ্রামেও বাড়ি করতে হলে প্ল্যান নিতে হচ্ছে। এগুলো কিন্তু পরিকল্পিত কাজেরই নিদর্শন। জলবায়ু পরিবর্তন, শহরায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আসিফ আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবর্তনে হেলদি সিটির কাজ শুরু হয়েছে। এখন ক্লিন সিটির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান। সেচ পানির সমস্যা, তেরখাদা, ডুমুরিয়ায় জলাবদ্ধতা, কৃষি শ্রমিক স্বল্পতা, বেড়িবাঁধ সমস্যা রয়েছে। নদী ও খাল খনন করাসহ স্লুইস গেট সংস্কার করা প্রয়োজন। খাল ইজারা মৎস্য চাষীদের দেওয়ায় কৃষকরা পানি পায় না। কিন্তু সরকার নামমাত্র রাজস্ব নেয়। একই রাজস্বে প্রকৃত কৃষক পেলে ফসল উৎপাদন বাড়বে। খালেও পানি প্রবাহ গতিশীল থাকবে। জলাধার থাকতে হবে। জলাধার নেই বলেই হিট ওয়েভও বাড়ছে।’
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়নের জিএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রকৃতিকে বাঁধাগ্রস্ত করলে প্রকৃতি সেভাবেই ফিড ব্যাক দেবে। ১৯৭৩ সালে জরিপে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। ২০০০ সালের জরিপে লবণাক্ততার মাত্রা ১ লাখ ২০ হাজার ৭৫০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ততা ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। ২০২১ সালের জরিপের ফলাফল আগামী নভেম্বরে প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত লবণাক্ত হয় ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি। উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়।’
তিনি বলেন, মার্চ মাসে ৯ দশমিক ৭৭ ডেসিবল ছিল লবণাক্ততা, যা এপ্রিল মাসে ২৩ দশমিক ৭৭ ডেসিবলে উন্নীত হয়। বৃষ্টি কমলে বেড়ে যায়। আগে আমন চাষের পর জমি পতিত থাকতো। এখন ভুট্টা, সূর্যমুখীসহ লবণসহিষ্ণু ধান চাষ হচ্ছে।
Leave a Reply