রক্তচোষা নামটি শুনলেই একটি রহস্যময় অনুভূতি তৈরি হয়। বিশেষ করে যখন তা ‘বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি’র সাথে যুক্ত হয়।
অঞ্চলভেদে “রক্তচোষা” বা “কাকলাশ” বিভিন্ন নামে বিভিন্ন এলাকায় পরিচিত। এই নামের উৎপত্তি মূলত পুরুষ গিরগিটির প্রজননকালে তাদের গলার লাল রং ধারণ থেকে এসেছে। তবে, লোককথার ভিত্তিতে অনেকেই বিশ্বাস করে যে এই গিরগিটি দূর থেকে রক্ত শুষে নেয়। এই প্রচলিত মিথ পুরোপুরি ভিত্তিহীন।
প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টি এবং জীববৈচিত্র্যের এক অপূর্ব প্রতীক হলো বন ঝুটিয়াল গিরগিটি। এদের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। এমনই প্রায় দুর্লভ এক গিরগিটি হলো ‘বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি’ বা ‘বনবাসী রক্তচোষা’। এদের ইংরেজিতে বলা হয় Forest Crested Lizard বা Emma Grays Forest Lizard, এবং এদের বৈজ্ঞানিক নাম Calotes emma।
প্রথম এই প্রাণীর সঙ্গে হয়েছিল গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে। গত বছর ১৩ই নভেম্বর এক বিকেলে ঝোপের ভেতরে হঠাৎ চোখে পড়ে এ প্রাণীটি। গিরগিটির এমন আশ্চর্য চেহারা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। তখন ঘুরাঘুরিতে ব্যস্ত থাকায় খুব একটা নজর দিতে পারিনি। পরে ছবি তুলে কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভে তুলে রেখে ছিলাম। কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় জানার আগ্রহে অনেক দিন ধরে অনুসন্ধান করতে থাকি। অবশেষে জানা গেল, এটি আমাদের দেশের প্রায় দুর্লভ ‘বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি’র এক প্রজাতি।
‘বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি’ মূলত বনাঞ্চলে বসবাসকারী গিরগিটি এরা Agamidae পরিবারের সদস্য। গিরগিটির এই প্রজাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এরা রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এরা লালচে বর্ণ ধারণ করে, যা দেখে সাধারণ মানুষ মনে করে যে তারা রক্ত চুষে নিচ্ছে। এ কারণেই তাদের ‘রক্তচোষা’ নামে ডাকা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা একদমই নিরীহ এবং মানুষের কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। বরং এরা কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
একটি পূর্ণবয়স্ক ‘বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি’ সাধারণত ৪১-৪২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চোখের উপরের একজোড়া কাঁটা বাদ দিলে এদের চেহারা বাগানের গিরগিটির মতোই। এদের গায়ের রং বাদামি, যাতে কালো দাগ বা ফোঁটা দেখা যায়। দেহের নিচের অংশ সাদাটে এবং মাথা ও গলা কালো রং ধারণ করে উত্তেজনার সময়। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ঘাড় ও পিঠে একটি চূড়া বা ঝুঁটি দেখা যায়, যা অন্য সাধারণ গিরগিটিগুলোর তুলনায় এদের আলাদা করে তোলে।
‘বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি’ দিনভর সক্রিয় থাকে এবং মূলত গাছপালায় বাস করে। এরা একাকী বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। প্রধান খাদ্য হলো পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ। বাংলাদেশে এদের প্রধানত ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, সিলেট ও চট্টগ্রামের মিশ্র চিরসবুজ বনে দেখা যায়। এছাড়াও, ভারত, চীন, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে এদের দেখা মেলে।
গিরগিটির প্রজনন সংক্রান্ত তথ্য এখনো পর্যাপ্তভাবে জানা যায়নি। তবে, জানা গেছে যে একটি স্ত্রী ‘বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি’ প্রায় ১২টি ডিম দেয়। এই প্রজাতির জীববিজ্ঞান ও প্রজনন নিয়ে আরও গবেষণা করা অত্যন্ত জরুরি। এদের প্রজনন ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করলে, এই বিরল প্রজাতির সংরক্ষণে সহায়ক হবে।
বন ঝুঁটিয়াল গিরগিটি আমাদের পরিবেশের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এরা ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেকেই এদের ভুল ধারণার বশে ক্ষতি করে। আমাদের সচেতন হওয়া উচিত এবং এদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
Leave a Reply