বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি সমাজে বসবাসরত অধিকাংশ যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন বুকে লালন করে। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের আগমন ঘটেছে মূলত ল্যাটিন শব্দ Universitas থেকে। এই বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের সূচনা ঘটে দ্বাদশ শতকে। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের গড়ে উঠার পথ ছিল না মোটেও সহজ। ইউরোপে মধ্যযুগ শুরু হয় রোমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যে দিয়ে। রোমানদের পতন ইউরোপে বিশাল এক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটি হলো, সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ছিল খ্রিস্টান ধর্ম যাজকদের আধিপত্য। তাদের আধিপত্য এতটাই ছিল যে, সেসময়ে কেউ জ্ঞান চর্চা করতে পারতো না। কারণ তারা মনে করতো, জ্ঞানের অনুশীলন নিষ্প্রয়োজন, এটি নিতান্তই বিধর্মীদের অলস মস্তিষ্কের আবর্জনা মাত্র। ফলে ইউরোপ জুড়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার। এজন্য ইউরোপের এই সময়কালকে অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ইউরোপের মধ্যযুগ যে অন্ধকার যুগই ছিল তার প্রমাণ বহন করে চার্চ থিওফেলাসের নির্দেশে লাইব্রেরী ধ্বংস। এছাড়া, সেসময় প্লেটোর অ্যাকাডেমি বন্ধ এবং সর্বপ্রকার গ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শন প্রচার ছিল আইনত নিষিদ্ধ।
এই অন্ধকার বা অজ্ঞতার যুগের অবসান ঘটতে থাকে নবম শতকে সম্রাট শার্লামেনের হাত ধরে। অর্থাৎ তার নির্দেশে তৎকালীন সকল মঠ ও গীর্জা গুলো হয়ে উঠে এক একটা শিক্ষা কেন্দ্র। সমকালীন সময়ে শহরের বিকাশ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ইউরোপের সর্বত্র শিক্ষা বিস্তারের পথ বেশ সুগম করে দেয়। সেসময়ে মঠ গুলোই ছিল প্রকৃত শিক্ষা কেন্দ্র। কারণ তখনও খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের ছিল চরম আধিপত্য এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তারাও জ্ঞান চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধিসহ শিক্ষার চাহিদা বাড়তে থাকে সবর্ত্র। ফলে দ্বাদশ শতকে এই শিক্ষাকেন্দ্র গুলোই স্ফীত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর বৈশিষ্ট্য আপনাকে আমাকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর বৈশিষ্ট্যের কথায় স্মরণ করিয়ে দিবে। কেননা, এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ছিল শাসকদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও স্বাধীন, যেটাকে আমরা বর্তমান সময়ে বলে থাকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বিভিন্ন ডিগ্রি প্রদান করে থাকতো। যেমন; স্নাতক বা ব্যাচেলর ডিগ্রি, মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তর, ডক্টর অফ ফিলোসোফি বা পিএইচডি। যেমনটা বর্তমান আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি হতে নির্দিষ্ট বয়সসীমা ছিল এবং স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য ৩ থেকে ৪ বছর অধ্যয়ন করতে হতো। ধর্ম শাস্ত্রের উপরে মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তর করতে ৩৫ বছর বয়সী হতে হতো এবং ১০ বছর অধ্যয়ন করতে হতো। এছাড়া, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য একজন প্রার্থীকে ৩৫ বছর বয়সী হতে হতো এবং সে বিষয়ে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করতে হতো। অত:পর সেই প্রার্থীকে গবেষণা পত্র জমাদানের পরে একাধারে কয়েকটি মৌখিক পরীক্ষা ও খোলা মাঠে জনগণের অগণিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। যদি কোনো প্রার্থী এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম হতো তাহলে তাকে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হতো না।
এমন ডিগ্রি অর্জনের পন্থা বর্তমান আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও লক্ষ্য করা যায়। তবে সময়ের সাথে পরীক্ষা পদ্ধতি কিছুটা পরিবর্তন হলেও সেসময়ের মূল ধারা অব্যাহত রয়েছে। মধ্যযুগের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তিনটি বিষয়ের জন্য বিখ্যাত, যেমন; স্যালারনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্য বিখ্যাত, বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আইন শাস্ত্রের জন্য বিখ্যাত এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ধর্ম শাস্ত্রের জন্য বিখ্যাত। এমনটা বর্তমান আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও লক্ষ্য করা যায়, যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের জন্য বিখ্যাত।
মধ্যযুগের ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ছিল সাম্যবাদের প্রতীক। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সমাজে সাম্যবাদের বীজ বপণ করতে শুরু করেছিল। ফলে সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের অবিচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল, সোচ্চার হয়েছিল নিজ অধিকার আদায় ও সংরক্ষণের ব্যাপারে। আমরা যদি কিছুটা পিছন ফিরেই দেখি তাহলে দেখতে পারবো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে কাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য? আমরা সবাই জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্বে যত বড় বড় আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে তার অধিকাংশ শুরু ও সফল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। অর্থাৎ অধিকার আদায়ে এবং সমাজে সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোভাব এখনও ভূমিকা রাখছে।
মধ্যযুগে ইউরোপের এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোই মূলত সমাজের অজ্ঞতা ও অন্ধকার দূর করে একটি সমৃদ্ধশালী আধুনিক ইউরোপ গঠন করেছিল। যে ইউরোপ পরবর্তীতে বহির্বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষাব্যবস্থা ছড়িয়ে দিয়েছিলো। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোই বর্তমান সময়ের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা এবং শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
Leave a Reply