1. admin@gmail.com : দৈনিক আমার সময় : দৈনিক আমার সময়
  2. : admin :
বিশ্ব বনঅরণ্য দিবস হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বন, সাথে পশু পাখিও - দৈনিক আমার সময়

বিশ্ব বনঅরণ্য দিবস হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বন, সাথে পশু পাখিও

দিদারুল আলম সিকদার, কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি
    প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০২৪
দেশে প্রায় ২৬ লাখ হেক্টর আয়তনের বনাঞ্চল রয়েছে, যারমধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি বৃহত্তর চট্টগ্রামে অবস্থিত। একসময় দেশের সবচেয়ে ঘন ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ চিরহরিৎ বনাঞ্চল ছিল এখানে। এমনকি এখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া উদ্ভিদের এত বেশি ঘন বন ছিল যে, মাটিতে সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌঁছাত না। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামের সেই চিরহরিৎ বনাঞ্চল এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। সেসাথে হারিয়ে যাচ্ছে এসব বনাঞ্চলের উপর নির্ভরশীল স্থানীয় প্রজাতির পশু-পাখি।
এরই মাঝে মানুষের জন্য বনের গুরুত্ব তুলে ধরতে আজ ২১ মার্চ ‘বন এবং উদ্ভাবন: একটি উন্নত বিশ্বের জন্য নতুন সমাধান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সারাবিশে^র মতো বাংলাদেশেও উদযাপিত হচ্ছে ‘বিশ্ব অরণ্য দিবস’।
একসময় চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে দক্ষিণে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত এবং সমুদ্র উপকূল থেকে পূর্বদিকে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ‘চট্টগ্রাম হিল’-এ ছিল ঘন বৃক্ষ আচ্ছাদিত চিরহরিৎ বন। এই বনাঞ্চলে ছিল বৈচিত্র্যময় পশু-পাখির বসবাস। এই বনের ছিল এক অসাধারণ স্থাপত্য, যা বিমোহিত করত দেশী-বিদেশী মানুষকে। বনের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো চলচ্চিত্র শিল্পের প্রসার ঘটায়। কিন্তু একদিকে দেশীজাতের বৃক্ষ ও লতাগুল্মের বন ধ্বংস এবং অন্যদিকে বিদেশী জাতের চারা লাগানোর কারণে ঐতিহ্যবাহী ‘চট্টগ্রাম হিল’-এর সেই চিরহরিৎ বনাঞ্চল এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। সেসাথে শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা এই প্রাকৃতিক বনের বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ছে।
জলবায়ু পরিস্থিতি এবং গাছের প্রকারের উপর ভিত্তি করে বনকে গ্রীষ্মমন্ডলীয়, চিরহরিৎ, আংশিক চিরহরিৎ, পর্ণমোচী এবং শুষ্ক বন হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। হ্রদ, পুকুর, মাটি, শিলা ইত্যাদির মতো অজৈব উপাদানও নিয়ে বন গঠিত হতে পারে। একটি বনকে একটি বাস্তুতন্ত্র গঠনকারী এলাকা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
আর ‘ইকোসিস্টেমস’ বা বাস্তুতন্ত্র বলা হয় সেই পরিবেশকে, যেখানে উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, পানি এবং অণুজীবগুলি যেখানে একসাথে বসবাস করে এবং অস্তিত্বের জন্য একে অপরের উপর নির্ভর করে।
পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, বন পৃথিবীতে জলচক্র বজায় রাখতে সাহায্য করে। গাছপালা তাদের শিকড়ের মাধ্যমে মাটি থেকে পানি শোষণ করে। উদ্ভিদের অতিরিক্ত জল জলীয় বাষ্প আকারে বায়ুমন্ডলে ত্যাগ করা হয়, যে প্রক্রিয়াটিকে ট্রান্সপিরেশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় মহাসাগর থেকে জলীয় বাষ্প উঠে যায় এবং ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে। এরপর সমুদ্রের বাতাসের কারণে মেঘ বৃষ্টিপাত আকারে স্থলভাগে নেমে আসে। এই প্রক্রিয়াগুলি একসাথে জলচক্র গঠন করে। জলচক্র অব্যাহত রাখতে বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বন বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা এবং অক্সিজেন স্তর বজায় রাখতেও সাহায্য করে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের সময় অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। বনাঞ্চলগুলো গাছপালা এবং গাছের একটি বিশাল ভান্ডার হওয়ায় এই বন বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন স্তরের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বনভূমি বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে সাহায্য করে। বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের (গ্রিনহাউস গ্যাস) বর্ধিত পরিমাণ গ্রিনহাউস প্রভাবে পরিণত হয় এবং এর ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটে।
বনভূমি মাটি ক্ষয় রোধ করে। বনাঞ্চলে উপস্থিত গাছ মাটির কণাকে শিকড় দিয়ে শক্তভাবে ধরে রাখে এবং ক্ষয় থেকে রক্ষা করে।
বন কার্বনের মতো বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে পরিবেশ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। বনাঞ্চল মাটির ক্ষয় রোধ করতে এবং মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রকৃতিতে অক্সিজেন এবং কার্বনের ভারসাম্য স্থাপনে সহায়তা করে। তাই পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বন অপরিহার্য বলে মনে করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী ছিদ্দিকী।
তিনি বলেন, বন অনেক জীবন্ত প্রাণীর ঘর। বনে বসবাসকারী জীবনগুলো একে অপরের উপর নির্ভরশীল। বনের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় বায়ু, পানি এবং সূর্যালোকের মতো প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে। জলবায়ুর উপর নির্ভর করেই বেশিরভাগ বনাঞ্চলে বনজ, ভেষজ ও লতা-গুল্ম জাতীয় গাছ জন্মে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব খাদ্য তৈরি করে এবং প্রাণীরা তাদের খাদ্যের জন্য উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর নির্ভর করে। কখনও কখনও গাছপালা তাদের পুস্প পরাগায়ন এবং বীজ বিচ্ছুরণের মতো প্রক্রিয়ার জন্য প্রাণীদের উপর নির্ভর করে। কিন্তু স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ ধ্বংস করে নননেটিভ বা বিদেশী প্রজাতির উদ্ভিদের বনাঞ্চল তৈরির কারণে স্থানীয় জাতের পশু-পাখিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আর প্রাকৃতিক চক্রগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষের জন্য বিরূপ পরিবেশ তৈরি করছে। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাও।
বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনছারুল করিম বলেন, অতীতের বন পুনরুদ্ধার কর্মসূচিগুলিতে বনের পরিবেশগত কার্যকারিতা, জীববৈচিত্র্য এবং কার্বনের সহ-সুবিধাগুলো বিবেচনা না করে কেবল গাছের আচ্ছাদন উন্নত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে এখানে বন আছে, কিন্তু বনে পশু-পাখি নেই।
তবে বনবিভাগ দেশীয় প্রজাতির গাছপালা লাগিয়ে সেই ঘন বন পূনরুদ্ধার করবে এবং কক্সবাজারকে সারাবিশে^ একটি মডেল হিসাবে উপস্থাপন করবে বলে জানান প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আমির হোসেন চৌধুরী।
তিনি বিদেশি প্রজাতির গাছের বনায়নের বিরোধিতা করে বলেন, বিদেশী প্রজাতির গাছ আমাদের পশু-পাখির বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগিয়েই আমাদের জীববৈচিত্র্য পূনরুদ্ধার করতে হবে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বনের বাস্তুতন্ত্র বন্য গাছপালা এবং প্রাণীদের বাসস্থান সরবরাহ করে, বিভিন্ন ফুড চেইন ও খাবারের ওয়েবগুলিকে ঠিক রাখে, প্রয়োজনীয় পরিবেশগত প্রক্রিয়া ও জীবন ধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। জৈব ও জৈব উপাদানগুলির মধ্যে পুষ্টি পুনর্ব্যবহারের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। বাস্তুতন্ত্র পানিচক্র, কার্বন চক্র, অক্সিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র ও শক্তি চক্রসহ একই বাস্তুতন্ত্রের শক্তির যথাযথ প্রবাহ বজায় রাখে। আর পৃথিবীতে কয়েক লক্ষ স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। একটি পুকুর বা কুয়াকে কেন্দ্র করেও স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠতে পারে। তবে পৃথিবীতে মূলত ৬ ধরনের বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। এগুলো হল বনভ‚মি, তৃণভূমি, মরুভূমি, মিঠা পানি ও সামুদ্রিক পানির জলাধার এবং আর্কটিক টুন্ড্রা। এসব বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে বনভ‚মি মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত। বন হল প্রকৃতি প্রদত্ত একটি মূল্যবান সম্পদ। অথচ দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও সেখানে রয়েছে মাত্র ৯ ভাগ। আর যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে সেই বনাঞ্চলও দিনদিন বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
গত তিন দশকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে অন্তত ১ লাখ হেক্টর প্রাকৃতিক বন কমেছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা। ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরা’ ও ‘ওয়াটার কিপার্স’ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, এছাড়া স্বাধীনতার পরে কমেছে আরো সমপরিমাণ।
জানা যায়, কক্সবাজারে গত তিন দশকে প্রায় ৭৭ হাজার একর বনভূমি বেহাত হয়েছে বনবিভাগের। কক্সবাজারের চকরিয়ায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় সুন্দরবন এখন কেবলই স্মৃতি। কিন্তু সাম্প্রতিককালেও বিপুল বনের জমি বেহাত হচ্ছে। পাহাড় কেটে সাবাড় করছে দূবৃৃত্তরা। আর সংশ্লিষ্টরা দেখেও যেন না দেখার ভান করছে।
বনবিভাগের হিসেব মতে, জেলায় বিভিন্ন সময়ে ৪৫ হাজার ৯৯০ একর বনভুমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। এ জমি দখলে রয়েছে ৪৩ হাজার ৫৬৮ জন ব্যক্তি ও ৬৯৬ টি প্রতিষ্ঠান।  এরমধ্যে কক্সবাজার শহর ও আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সরকারি বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরকে ১৪ হাজার ৩৭২ একর বনভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া উপকূলীয় বনের মধ্যে ১০ হাজার ৪৬০ একর জমি বনবিভাগ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে রেলপথ নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বিপুল পরিমাণ বনভূমি হাতছাড়া হয়েছে। যা এখনও রেকর্ডে আসেনি।
সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের অদূরে মেরিন ড্রাইভ সড়কের শুকনা ছড়ি এলাকায় প্রশাসন একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্যে ৭০০ একর বনভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। দেশের পরিবেশবাদীদের বাধার মুখে ও উচ্চ আদালতের নির্দেশে এ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে মোটা দাগের বনভূমি হাতছাড়া হয়েছে ২০১৭ সালে।
ওই বছরের ২৫ আগস্টের পরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী উখিয়া ও টেকনাফে ৬ হাজার ১৬৪ একর বনভূমি ছেড়ে দেওয়া হয়। সেসাথে এখনও প্রতিদিন কোন না এলাকায় প্রভাবশালীদের হাতে জবর দখলের শিকার হচ্ছে সরকারী বনভূমি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন
© All rights reserved © dailyamarsomoy.com