২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
বাবা রক্তে-মাংসে একজন খাঁটি বাঙালি ছিলেন। তিনি আবেগ- অনুভূতিতে সবসময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালো বাসতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বাবার মুখ থেকে শোনা একটি ঘটনা হুবহু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র ‘ তোরা তো দেখিস নাই, শেখ মুজিব কত বড় লম্বা মানুষ ছিল, কেমন সাহসী ছিল, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মানুষ খুবই কম ছিল! মুজিব ভাই’র কন্ঠে জাদু ছিল।
যখন মাদারীপুর জজকোর্ট লেকের পাড় বর্তমান বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজ প্রাঙ্গণে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তখন আমরা তাঁকে একপলক দেখার জন্য লক্ষ মানুষের ভিড় ঠেলে মাদারীপুর শকুনি লেকের পাড়ে হাজির হই।
মানুষের ভিড়ের কারণে আমরা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে না পেয়ে গাছে চড়েছিলাম এবং অবশেষে দেখতে পেয়েছিলাম। তাঁর ভাষণ শোনার জন্য মহিলারা পর্যন্ত মাইলের পরে মাইল পায়ে হেঁটে মাদারীপুর উপস্হিত হয়েছিল।
ঐ প্রথম শেখ মুজিবকে সরাসরি দেখি। এটা যে কি আনন্দ, এটা যে কি অনুভূতি তা তোদের আমি ভাষায় প্রকাশ করে বুঝাতে পারবোনা। ‘
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয় এবং তাঁর নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীচক্র।
আগস্ট মাস আসলেই বাবা কেমন যেনো চুপসে যেতেন। তাঁর মধ্যে কোনো আনন্দ, হাসি কিংবা উৎফুল্লতা দেখা যেত না। কেমন যেন মন মরা মরা দেখাইতো তাঁকে।
আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সব বিষয়ে বলেন এবং তিনি বলতে গিয়ে বার বার মূর্ছা যান।
বাবা আমাদের পরিবারের সবাইকে আদেশ করেছিলেন যে, তোমরা আগস্ট মাসে কোনো বিবাহসাদী কিংবা কোনো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করিবে না। আমরাও বাবার আদেশ মোতাবেক সবকিছু পালন করে আসছিলাম।
বাবার হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মাসেই তিনি নিজেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সৃষ্টিকর্তা হয়তো বাবার ইচ্ছে পূরণ করেছেন!
একদিকে জাতির পিতাকে হারানোর মাস অন্যদিকে আমার জন্মদাতা বাবাকে হারানোর মাস আগস্ট। এই যন্ত্রণা, দুঃখ কষ্টকে বুকে চাপা দিয়ে জীবন চলছে!
দেখতে দেখতে বাবার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপনিত হয়েছে। বাবার শূণ্যতা প্রতিটি ক্ষণে অনুভব করি। জীবন চলছে জীবনের মতো কিন্তু কোথায় যেনো শূণ্যতার হাহাকার আমাকে ডুকরে ডুকরে খাচ্ছে।
হায়রে জীবন! হায়রে কপাল! এতো তাড়াতাড়ি বাবা বলে ডাকা থেকে বঞ্চিত হইলাম। কত মানুষ দেখি বাবার মতো কাউকে খুঁজে পাইনা!
সবই বিধাতার খেলা!
বাবা দেখতে এতো কিছু বুঝিনি, বাবা মানুষের জীবনের এতো অপরিহার্য। হারিয়ে বুঝতেছি।
বাবা মানে নির্ভরতার প্রতীক। বাবা মানে বটবৃক্ষ। বাবা মানে প্রখর রোদে শীতল ছায়া। বাবা মানে নির্ভরতা অন্ধকার পথের দিশা। আদর-স্নেহ -শাসন, আশ্রয় -প্রশ্রয় আর মমতায় মাখা নাম।
বাবা নেই মানে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সব স্বপ্ন, সব আশা শুধুই মরিচিকাময়।
বড় বড় মানুষেরা বলে গেছেন, পৃথিবীতে খারাপ মানুষ থাকতে পারে, কিন্তু খারাপ বাবা একটিও নেই। বাবারা বোধ করি এমনি হন—সেলফলেস, সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখা। বাবা শব্দটা যতটা সহজ মনে হয় ঠিক ততখানি সহজ না, তার থেকে অনেক বেশি অর্থ বহন করে। বাবা যেন ছায়া দানকারী বিশাল মহিরুহের স্বরূপ।
সন্তানের কাছে আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। সন্তান বাবার ঋণ কখনো পরিমাপ করতেও পারে না। উত্তপ্ত সূর্যের তলে সন্তানের জন্য শীতল ছায়া হয়ে থাকেন বাবা। সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় বাবাকে।
আমাদের স্বার্থেই বাবাদের বেশি বেশি ভালো বাসতে হবে। দুনিয়াতে থাকতেই বেশি করে শ্রদ্ধার জায়গায় আসন দিতে হবে। অন্যথায় হারিয়ে গেলে সারা জীবন কপাল ঠুকরেও লাভ হবে না।
আমার বাবা নাই আমি জানি আমার জীবনে বাবার কতটা প্রয়োজন, আমি প্রতিটি মুহূর্ত বাবাকে অনুভব করি।এর চাইতে আর কি দিয়ে পাঠক হৃদয়কে বুঝাবো প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে বাবার উপস্হিতি কতখানি আবশ্যক।
বাবার অনুপস্থিতি প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে টের পাই।
এই শূণ্যতা পৃথিবী কোনো পূর্ণতাই পূরণ হবার নয়। আপনার আমার জীবনের সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে বাবা। তিনি রক্তে মাংসে একজন মানুষ বৈকি কিন্তু সন্তানের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিকান্ডের মধ্যেও জ্বল জ্বল করে জ্বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি বাবা নামক একটি ছোট্র শব্দ।
আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। এমন করেই পৃথিবীময় হয়ে উঠুক বাবার ভালোবাসায় সন্তানের প্রেম। কোনো বৃদ্ধাআশ্রমে যেনো কোনো বাবাকে কাঁদতে না হয়। চোখের জলে সন্তানের নাম নিতে হয়।
বাবারা যেমন সন্তানের জন্য অগ্নিকুণ্ডে ঝাপ দিতেও দ্বিধাবোধ করেননা তেমনি সন্তানরা যেনো বৃদ্ধ বয়সে ভালোবাসার কমতি না রাখেন বাবাদের প্রতি।
পৃথিবীর সমস্ত বাবারা শান্তিতে থাকুক, ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখুক পৃথিবীময়। আর আমার মত যাঁরা এতো তাড়াতাড়ি বাবাকে হারিয়ে ব্যাকুল, তাঁদের জন্য শান্ত্বনা।
বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ছড়িয়ে পড়ুক আমার আপনার মাধ্যমে। আর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে বেশি বেশি প্রার্থনা করি বাবার অনন্তকালের শান্তির জন্য।
Leave a Reply