1. : admin :
"হীরা লাল সেনকে জাতীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক" - দৈনিক আমার সময়

“হীরা লাল সেনকে জাতীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক”

আমার সময় ডেস্ক
    প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩

 

আমরা আমাদের গুনিনদের সঠিক মুল্যায়ন করছি কি! গোলাম মোস্তফা, বুলবুল আহমেদ, হুমায়ূন ফরিদী, হুমায়ূন আহমেদ, চিত্র নায়ক রাজ্জাক কিংবা এস এম সুলতান। তাদের নিয়ে খুব একটা লেখালেখি আমার চোখে পড়েনা নেহাত জন্মদিন আর মৃত্যু বার্ষিকী ছাড়া। কেমন যেন মনে হয় সাহিত্যিক কিংবা সাংবাদিকদের দায় সারা আরকি। অবশ্যই আমাদের গুনিনদের নিয়ে বারংবার লিখতে হবে, নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাটাই আমাদের কর্তব্য। আমরা সঠিক ইতিহাস যদি না লিখি তাহলে নতুন প্রজন্ম জানবে কি ভাবে আমাদের সঠিক ইতিহাস! আমাদের গুনিনদের সম্পর্কে। আমি একজন অরাজনৈতিক সাহিত্যিক এবং পুরোদস্তুর মিডিয়া কর্মী, তাই অকপটে সত্য বলাটাই আমার কাজ। বলতে পারেন সোজাসাপ্টা সত্য বলা অথবা লেখাই আমার মূল মন্ত্র কিংবা ধর্ম। আমরা ভিন্নদেশি গুনিনদের যেভাবে মুল্যায়ন করছি! যেভাবে প্রচার প্রসার করছি সেতুলনায় আমাদের গুনিনদের মূল্যায়ন শূন্য কোঠায়। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, সেভাবে আমাদের নিজেস্ব গুনিনদের মুল্যায়ন করছি কি! অবশ্যই করছিনা। প্রথমত আমি হীরা লাল সেন,র কথা বলছি। অবশ্য আপনারা অনেকেই জানেন না হীরা লাল সেন কে? সে কতবড় গুনিন আমাদের দেশের। তাকে নিয়ে কি পরিমানে গবেষণা ও গর্ব করা যায়, তা শুনলে আপনি অবাকই হবেন। অবশ্য কিছু সচেতন ব্যাক্তিরা হীরা লাল সেন সম্পর্কে বেশ সজাগ। কিন্তু সরকারি ভাবে কোন মূল্যায়ন করা হয়না এই গুনিনকে অথচ আমরা ভিন্নদেশি সম্মানিত সত্যজিৎ রায় কে নিয়ে গবেষণা করি, তাকে নিয়েই গর্ব করি অথচ সত্যজিৎ রায়ের চেয়ে ও অনেক বড়মাপের গুনিন হলেন হীরা লাল সেন। হীরালাল সেন ভারত উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রথম বিখ্যাত ফটোগ্রাফার, ভারত উপমহাদেশের প্রথম বিজ্ঞাপন নির্মাতা সহ অনেকগুলো রেকর্ড তার ঝুলিতে রয়েছে। আমাদের ঢাকার সন্তান ভারত উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার, চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়েও তাকে আমরা সঠিক সম্মানে সম্মানিত করতে পারিনি, কিন্তু কেন।
তিনি কিন্তু কাজি নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নয়। আমরা সম্মানিত কাজী নজরুল ইসলামকে এদেশে এনে নাগরিক করিয়েছি কিন্তু হীরালাল সেন এ দেশের ই সন্তান, এই দেশের মাটিতেই তার জন্ম। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকায় তার জন্ম ও পৃত্যভূমী।
হীরালাল সেন ১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে আনুমানিক ৮০ কিলোমিটার দূরে মানিকগঞ্জের বাগজুরী গ্রামে। তিনি ঐ অঞ্চলের একজন বৈদ্য জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল বাংলার অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্গত । হীরা লাল সেনের পিতা চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন একজন সফল আইনজীবী । পিতা চন্দ্রমোহন সেন এবং মাতা বিধুমুখী দেবীর আট জন সন্তানদের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন হীরালাল সেন। হীরালাল সেন নারায়ণগঞ্জ থেকে স্কুল জিবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হতে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানকার একটি কলেজে ভর্তি হন। তরুণ ছাত্র বয়সেই ফটোগ্রাফি শিল্পের প্রতি গভীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। ১৮৯০ সালের মধ্যে, তিনি ফটোগ্রাফিতে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বেশ কয়েকটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন এবং বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ ও কলকাতায় তাঁর ফটোগ্রাফিক স্টুডিও চালু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর ভাই মতিলাল সেনের সহায়তায় তিনি লন্ডনে চার্লস আরবানের ওয়ারউইক ট্রেডিং কোম্পানি থেকে একটি আরবান বায়োস্কোপ কিনেছিলেন।
হীরালাল সেনের ব্যবসায়িক দক্ষতার অভাব ছিলনা যার সাহায্যে হয়তো তিনি চলচ্চিত্র মাধ্যমটির সাথে বাণিজ্যিক সাফল্য সহজেই খুঁজে পেতেন । বাবা চন্দ্রনাথ সেন তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। সেন একটি সিনেমাটোগ্রাফ মেশিন কিনতে সেকালে রাজকীয়ভাবে ৫০০০ টাকা খরচ করেছিলেন। প্রজেকশন সরঞ্জাম সহ সমগ্র যন্ত্রপাতি ইংল্যান্ড থেকে কিনতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর ভাই মতিলালের সাথে, সেন ১৮৯৮ সালে দ্য রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি স্থাপন করেন, যা ছিল সমগ্র ভারত উপমহাদেশের প্রথম সিনেমা কোম্পানি।
প্রথম দিকে, তাঁরা ইংল্যান্ডের কোম্পানিগুলির দ্বারা নির্মিত চলচ্চিত্রগুলি ক্রয় করতেন এবং ধনীদের পার্টি এবং বিবাহে সেগুলি দেখাত। এগুলি ছিল মূলত ইংরেজদের দ্বারা কলকাতা ও ভারতের রাস্তায় দৈনন্দিন জীবনের চিত্রায়িত ছবি। হীরালালের চলচ্চিত্র তৈরির সৃজনশীল কর্মজীবন ১৯১৩ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। হীরালাল সেন চল্লিশটিরও বেশি শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলেন। কলকাতায় অমরেন্দ্র দত্তের ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনয় করা নাট্য প্রযোজনা থেকে তিনি যে ছবিগুলি তৈরি করেছিলেন তার বেশিরভাগই চিত্রিত দৃশ্য। ১৯০১ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে তিনি ভ্রমর, হরিরাজ এবং বুদ্ধদেব সহ ক্লাসিক থিয়েটারের জন্য অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
তাঁর দীর্ঘতম চলচ্চিত্র ১৯০৩ সালে নির্মিত হয়েছিল এবং এর শিরোনাম ছিল আলিবাবা এবং চল্লিশ চোর। এছাড়াও তিনি কমিশন নিয়ে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্র এবং নিউজফিল্ম নির্মাণ করেন। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে জবাকুসুম হেয়ার অয়েল এবং এডওয়ার্ডস টনিকের বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে চলচ্চিত্র ব্যবহার করেন। ১৮৯৮ সালে, কলকাতার স্টার থিয়েটার সিনেমা প্রদর্শন শুরু করে।
সেন এবং তাঁর ভাই মতিলাল বুঝতে পেরেছিলেন যে চলচ্চিত্র ভবিষ্যতের একটি মাধ্যম হতে চলেছে। পরবর্তী সময় হীরালাল সেন জনজীবন, প্রকৃতি, রাজনৈতিক ঘটনা প্রভৃতি নিয়েও চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। অন্যদের বানানো ফিল্ম দেখিয়ে টাকা কামিয়ে হীরালাল সন্তুষ্ট হননি। তিনি নিজে ফিল্ম তৈরি করতে চেয়েছিলেন। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কুসুম কুমারীর সাথে হীরালাল সেনের একটি ফলপ্রসূ সম্পর্ক ছিল, তাঁরা স্টার্ট থিয়েটারে অভিনয় করতেন। হীরালাল সেন তাঁদের সাথে সহযোগিতা করেন এবং ক্লাসিক থিয়েটার দ্বারা নির্মিত তাঁর কিছু নাটকের চিত্রগ্রহণ করেন। প্রথমদিকে, থিয়েটারে স্টেজ শো-এর বিরতিতে এগুলো দেখানো হতো।
১৯০৪ সালে হীরালাল সেন লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে একটি জনসমাবেশ চলচ্চিত্র রূপে নিজের ক্যামেরার মাধ্যমে তৈরি করেন। সমাবেশের বিশালতা রেকর্ড করার জন্য, তিনি ট্রেজারি বিল্ড

সমাবেশের বিশালতা রেকর্ড করার জন্য, তিনি ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের উপরে ক্যামেরা স্থাপন করেছিলেন যাতে তিনি প্রায় দুই মাইল প্রসারিত বিশাল জনতার পটভূমিতে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি সহ বক্তাদের ছবি তুলতে পারেন।
১৯০৫ সালে,হীরালাল সেন একটি “আমাদের নিজস্ব তৈরি প্রকৃত স্বদেশী চলচ্চিত্র” বিজ্ঞাপন দেন। ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯০৫ তারিখে কলকাতার টাউন হলে সেনের তৈরি “বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বিক্ষোভ এবং স্বদেশী আন্দোলন” নামক চলচ্চিত্র নথিভুক্ত করা হয় । সমালোচক সমিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এটি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র।
সময়ের সাথে সাথে আমদানি করা চলচ্চিত্রগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করা হীরালাল সেনের কাছে কঠিন হতে শুরু করে। প্রতিযোগিতামূলক অন্য চলচ্চিত্রগুলির পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তিতে আরও ভাল আয়ত্ত থাকা ছিল এর কারণ । আর্থিক কষ্ট এবং স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে বাধ্য হয়ে, তিনি শেষ পর্যন্ত ব্যবসা বন্ধ করে দেন । এর কিছুদিন পরেই ১৯১৭ সালের অক্টোবরে, সেনের সমস্ত চলচ্চিত্রগুলি দুর্ঘটনাক্রমে এক অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। অসুস্থ ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া হীরালাল সেন এই নিষ্ঠুর সংবাদ পেয়েছিলেন যে রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানির পুরো স্টক যে গুদামটিতে রয়েছে সেখানে আগুন লেগেছে।
অগ্নিকাণ্ড তার তৈরি প্রতিটি চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং সেগুলির সাথে ভারতের প্রথম দিকের সিনেমার ইতিহাসের অনেক প্রমাণও ধ্বংস হয়ে যায়। এরফলে তিনি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন, এবং কয়েকদিন পর মারা যান।
হীরালাল সেনের পরবর্তী বছরগুলো ছিল হতাশা ও অর্থনৈতিক কষ্টে ভরা। জীবনের শেষ বছরের দিকগুলিতে তিনি এমন কঠিন সময়ের মধ্যে পড়েছিলেন যে তাঁকে তাঁর প্রিয় ক্যামেরাটি একজন সুদগ্রহীতার কাছে বিক্রি করতে হয়েছিল। তাঁর দুর্দশা আরো ভয়ানক হয়ে পড়ে যখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। হীরালাল সেন ১৯১৭ সালের ২৯ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান।
পরিশেষে আমাদের সজাগ হতে হবে যে, আমরা সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথকে সম্মানিত করতে গিয়ে আমাদের এস এম সুলতান, জয়নুল আবেদীন, হীরা লাল সেন কিংবা মাইকেল মধুসূদন দত্তের মূল্যায়নের ঘাটতি না হয়। আমাদের গুনিনদের সম্মান প্রদর্শন সহ বিশ্বের কাছে তুলে ধরাটাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
মানবিক মূল্যবোধের কারণে আমাদের সকল গুনিনদেরকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের গুনিনদের প্রচার প্রসার আমাদেরই করতে হবে, আমাদের গুনিনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা ব্যক্তি, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সবার মধ্যে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন করে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও সম্মান বোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেন এক পরিপূর্ণ ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি। আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিক মূল্যায়ন করি, আমরা হীরা লাল সেন এর জাতীয় সীকৃতি ও জাতীয় পর্যায় সম্মান প্রদর্শন করার পক্ষে আমি আপনি আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলি। জয় হোক মানবতার, জয় হোক বাংলার, জয় হোক বাংলাদেশের বাঙ্গালীর।

রানা বর্তমান
সাহিত্যিক ও নির্মাতা

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন
© All rights reserved © dailyamarsomoy.com