বৃহত্তম জোয়ারধৌত উষ্ণমণ্ডলীয় বাদাবন। আর এই বাদাবন হলো নদীর মোহনায় সমুদ্রের নোনা জলের কাদায় জন্মানো চির সবুজ বনভূমি, যার ঠেসমূল ও শ্বাসমূল আছে বিধায় সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ সহজ হয়। লবণাক্ত পানি-কাদায় জন্মানো ও বেরে উঠার পথ সুগম হয়ে থাকে। এটি আরও সহজভাবে যদি বলি, তা হলে এক কথায় বলতে হয় লবণাক্ত পানি-মাটির বন। তাই এই বনকে ম্যানগ্রোভ বন বলে অভিহিত করা হয়। উল্লেখ্য, কর্কটক্রান্তির সামান্য দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) ও বাংলাদেশের উপকূল ধরে বিস্তৃত ২১°৩০ থেকে ২২°৩০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°০০ থেকে ৮৯°৫৫ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যবর্তী স্থানে এ বনের অবস্থান।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, প্রায় ২০ লাখ বছর আগে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ জন্মলাভ করে। আর সুন্দরবন ছিল এই বদ্বীপের দক্ষিণমুখী অগ্রসরমান অঞ্চল। হাজার বছর ধরে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রবাহিত পলিমাটি নদীর স্রোতের সঙ্গে ভাটিতে নেমে এসে ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে বঙ্গীয় অববাহিকায়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান নদী দুটি হিমালয়ের পাদদেশে উৎপন্ন হলেও বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে এই বাংলাদেশের ভূমির ওপর দিয়ে।
এই কারণে এ অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য এক উর্বর ভূমি। সেই সঙ্গে উজানের মিঠাপানি ও সাগরের লোনাপানির সংমিশ্রণে অসংখ্য খাল-নদীসমৃদ্ধ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সৃষ্টির একটি উপযোগী পরিবেশ গড়ে ওঠে বিধায় যার সুবাদে আমাদের এই সুন্দরবন। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলার অংশবিশেষ এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাজুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত। পরস্পর সংযুক্ত ৪০০ নদী-নালা ও খালসহ প্রায় ২০০টি ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনের কলেবর।
দুঃখের বিষয় হলো, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর পূর্বেও মূল সুন্দরবনের এলাকা ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে সংকুচিত হয়ে প্রকৃত আয়তনের এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে। আর ব্রিটিশ ভারত বিভাগের প্রাক্কালে বনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা পশ্চিমবঙ্গে (ভারত)। এই বনভূমির বর্তমান আয়তন হবে প্রায় ৪,১১০ বর্গকিলোমিটার এবং এর প্রায় ১,৭০০ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি। বস্তুত এখন এটি অতীত সুন্দরবনের ভগ্নাংশমাত্র। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগেও বৃহত্তর যশোর জেলা এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পুরো এলাকা ছিল সুন্দরবনের আওতাভুক্ত সমজাতীয় গাছপালার এক বিস্তৃত বনাঞ্চল। এমন কী পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাও ছিল ম্যানগ্রোভ বনে আচ্ছাদিত। এ প্রেক্ষাপটে একটি কথা না বলে পারছি না। বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত ষাটগম্বুজ মসজিদের কথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। বিখ্যাত দরবেশ খানজাহান আলী তার অনুসারীদের নিয়ে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। সেই সময়ে মসজিদ নির্মাণের এ এলাকা ছিল বলতে গেলে সুন্দরবনের মধ্যাঞ্চল।
এদিকে ম্যানগ্রোভ হিসেবে সুন্দর বনের কথা বলতে গেলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কথা এসে যায়। বস্তুত ম্যানগ্রোভসমৃদ্ধ বিশ্বের প্রধান ১২টি দেশের মধ্যে আমাদের সুন্দরবনের অবস্থান অষ্টম। শতাংশের দিক দিয়ে এটি মাত্র ৩ দশমিক ৩। এ তালিকার প্রথমে আছে ইন্দোনেশিয়া, তারপর ব্রাজিল। এমন কী আমাদের পূর্ব-দক্ষিণ পাশের দেশ মিয়ানমারে যে ম্যানগ্রোভ বন আছে, সেটা আমাদের চেয়েও বড়। তা হলে অষ্টম অবস্থানে থেকেও সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম বন হলো কী করে?
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে-বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় এলাকায় গড়ে ওঠা সুন্দরবনটির বিশেষত্ব হলো, এ বন একক এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ও অখণ্ড। মানুষের হস্তক্ষেপে এটি এখনও বিভক্ত হয়ে পড়েনি এবং এর ফলে সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম বনের মর্যাদা ধরে রাখতে পেরেছে। বনটির গুণগত মান খুবই ভালো, বলতে গেলে সর্বদিক দিয়েই ইতিবাচক। কেননা এটি স্থিতিশীল, উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের দিক দিয়ে অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের চেয়ে তুলনামূলক উন্নত। তা ছাড়া এটি বেশ উৎপাদনশীল এবং প্রতিবেশ সেবার বৈচিত্র্যসহ এর কার্যক্রম অতুলনীয়।
আর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-এই সুন্দরবন ব্যতিরেকে পৃথিবীতে আর কোনো ম্যানগ্রোভ বনে বাঘ নেই। ফলে সুন্দরবন শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বের বিশেষ ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। যা হোক, সুন্দরবন ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো থেকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যদিও এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ। তথাপিও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে, যথাক্রমে ‘সুন্দরবন’ ও ‘সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান’ নামে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই নোনাজলের কাদায় জন্মানো বাদাবনের নাম সুন্দরবন হলো কীভাবে? সত্যি কথা বলতে কী, এ নামের ব্যাপারে আছে নানা অভিমত ও রহস্যঘেরা কথা। তথ্য মতে দেখা যায়, মোগল আমলে সুন্দরবনসহ বঙ্গীয় অঞ্চল ভাটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এই বাদাবন তথা ম্যানগ্রোভের অবস্থান সুপ্রাচীন হলেও সুন্দরবন নামটির প্রচলন হয় বেশ পরে।
ব্রিটিশরা এদেশ দখল করার বেশ কয়েক বছর পর অর্থাৎ ১৭৭৬ সালে বেঙ্গল ও আসাম অঞ্চলের একটি বিজ্ঞানসম্মত মানচিত্র করার উদ্যোগ নেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সার্ভেয়ার জেমস রিনেল। আর এই মানচিত্রে ‘Sundarbuns’ শব্দটির উল্লেখ করেন। অবশ্য এর নজির হিসেবে ১৭৮৮ সালের পরে প্রকাশিত ব্রিটিশ আমলের নানা নথিতে এ নামের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। যদিও এ নামের বানান কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে পরবর্তী সময়ে ‘
‘Sundarbuns’ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু জেমস রিনেল কিসের ওপর ভিত্তি করে এমন নাম দিয়েছিলেন, এরব্যাখ্যা তিনি দেননি।
এদিকে এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেন, সুন্দরবন যেহেতু সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত, তাই সুদূর অতীতে এর নাম ছিল সমুদ্রবন। পরে সমুদ্রবন নামটি বিবর্তিত হয়ে এর নাম হয় সুন্দরবন। আবার অনেকে বলে থাকেন যে হয়তো চন্দ্রবান্ধে (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে নামটি এসেছে। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ যেহেতু সুন্দরী। সেহেতু এই বৃক্ষের নামানুসারে সুন্দরবন নাম হওয়ার সম্ভাবনাই তুলনামূলক বেশি।
Leave a Reply