সাতক্ষীরা জেলা এর নামকরণ সম্পর্কে কয়েকটি মত প্রচলিত। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়কালে, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী নিলামের মাধ্যমে বুড়ন পরগণা কিনে সাতঘরিয়া গ্রামে নিজের বাড়ি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র প্রাণনাথ সাতঘরিয়ার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে এলাকাটিকে সুপরিচিত করেন।
সাতক্ষীরার মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫২ সালে, যশোর জেলার চতুর্থ মহকুমা হিসেবে। তখন এর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় কলারোয়াতে। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন নবাব আব্দুল লতিফ। ১৮৬১ সালে মহকুমা কার্যালয় সাতঘরিয়া গ্রামে স্থানান্তরিত হলে, ইংরেজ কর্মকর্তারা গ্রামটিকে “সাতক্ষীরা” নামে ডাকতে শুরু করেন। সেখান থেকেই পুরানো সাতঘরিয়া পরিচিত হয় আজকের সাতক্ষীরা নামে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত সাতক্ষীরা জেলা ইতিহাসে বুড়ন দ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। এর পাশেই ছিল চন্দ্রদ্বীপ, মধুদ্বীপ, সূর্যদ্বীপ, সঙ্গদ্বীপ ও জয়দ্বীপের মতো ছোট ছোট ভূখণ্ড, যা প্রাচীন মানচিত্র ও ইতিহাসে উল্লেখিত। ঠিক কোন সময়ে বুড়ন দ্বীপে সমাজবদ্ধ মানুষের বসতি শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে রামায়ণ ও মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী, এ অঞ্চলে সংঘবদ্ধ মানব বসতির গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। মহাভারতের তথ্য থেকে জানা যায়, মুনি কপিল পাইকগাছার কপিলমুনিতে একটি কালিমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে পূজা কার্য পরিচালনা করেন। এটি মহাভারতের যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন। সে সময় গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত গঙ্গারিডি নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যার অন্তর্গত ছিল বর্তমান সাতক্ষীরা। আলেকজান্ডারের পরবর্তী সময়ে, মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বুড়ন দ্বীপ ছিল পুণ্ড্র অঞ্চলের অন্তর্গত। তখন এটি খাড়িমণ্ডল নামে পরিচিত ছিল। চতুর্থ শতকে চন্দ্রবর্মণ খাড়ি অঞ্চল জয় করেন। এরপর বৌণ্যগুপ্ত (৫০৭-৫২৫ খ্রিস্টাব্দ) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার স্বাধীন নরপতি হিসেবে এই অঞ্চল শাসন করেন।
সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক, ভদ্রবংশ, খরগোরাত এবং লোকনাথ বংশের শাসনাধীনে ছিল এই অঞ্চল। বাংলার ইতিহাসে রাজা শশাঙ্ক একজন উল্লেখযোগ্য শাসক হিসেবে স্মরণীয়। সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে, গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের অধীনে অত্র জেলা আসে বলে ধারণা করা হয়। তিনি বাংলার প্রথম রাজা, যিনি শুধুমাত্র বাংলার সীমারেখার মধ্যে শাসন সীমাবদ্ধ না রেখে এর বাইরেও বহুদূর পর্যন্ত তাঁর সার্বভৌমত্ব বিস্তৃত করেন। শশাঙ্কের রাজত্বকালে বাংলার গৌরব বৃদ্ধি পায় এবং তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বিভিন্ন রাজ্য দখল করে নিজের সাম্রাজ্যের সীমানা প্রসারিত করেন। পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (খ্রিস্টাব্দ ৬৩৪) তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে গঙ্গারিডি রাজ্যের উল্লেখ করেছেন, যা পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, কজংগল, তাম্রলিপ্তি এবং সমতট প্রভৃতি নামের অঞ্চলসমূহের সমষ্টি ছিল। সমতটের একটি অংশই বর্তমান সাতক্ষীরা জেলা বলে জানা যায়।
অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পাল এবং বর্মণ রাজারা বুড়নদ্বীপ শাসন করেন। এই সময়কাল বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্থান এবং বিকাশের জন্য ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। পাল আমলের দশম শতাব্দীতে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র বংশের রাজা ত্রৈলক্য চন্দ্র এবং শ্রী চন্দ্র স্বাধীন শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। চন্দ্র বংশের রাজারা, বিশেষত শ্রী চন্দ্র, কল্যাণ চন্দ্র, লড়হচন্দ্র এবং গোবিন্দ চন্দ্র তাদের শাসনকালে জনপদকে সমৃদ্ধ করেন। গোবিন্দ চন্দ্র চন্দ্র বংশের সবচেয়ে প্রতাপশালী শাসক হিসেবে পরিচিত। তবে, চোল রাজা রাজেন্দ্র চোলের কাছে পরাজয়ের পর দক্ষিণ অঞ্চলের শাসন পাল বংশের হাতে চলে যায়।
একাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পাল রাজারা দক্ষিণ বাংলায় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। মহীপাল, তৃতীয় বিগ্রহ পাল, দ্বিতীয় মহীপাল এবং রামপাল এ সময়ের উল্লেখযোগ্য শাসক। এ সময়কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো কৈবর্ত বিদ্রোহ, যা রামপালের শাসনামলে ঘটে। এই বিদ্রোহের ফলে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে বর্মদের উত্থান ঘটে। বর্ম বংশের প্রখ্যাত রাজা ব্রজবর্ম এবং তাঁর পুত্র জাতবর্ম বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কলচুরি রাজকর্ণের শিলালিপিতে (১০৪৮-১০৪৯ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখ আছে যে জাতবর্ম দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চন্দ্র বংশীয় রাজাকে পরাজিত করে খুলনা অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করেন। জাতবর্ম অঙ্গ, কামরূপ এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে নিজ প্রভাব বিস্তার করেন।
বর্ম বংশের পরবর্তী শাসকদের মধ্যে হরিবর্ম, সালবর্ম এবং ভোজবর্ম উল্লেখযোগ্য। বর্ম বংশের পতনের পর সেন বংশের শাসন শুরু হয়। সেন বংশের তৃতীয় নৃপতি বিজয় সেন ছিলেন উল্লেখযোগ্য। ১০৯৭ থেকে ১১৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর শাসনকালে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন পদ্ধতি প্রচলিত হয়। বিজয় সেন শৈব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁর পুত্র বল্লাল সেন বাগড়ি অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করেন। বাগড়ি নামের উৎপত্তি বাউরি বা বাগুরি জাতির নাম থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। উপবঙ্গ প্রাচীনকালে নদী ও জঙ্গলে ঢাকা ছিল। বঙ্গ এবং উপবঙ্গের ভূগঠন প্রধানত গঙ্গা, মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্রের ব-দ্বীপ দ্বারা প্রভাবিত।
বাগড়ির দৈর্ঘ্য ছিল ৫৫০ মাইল এবং প্রস্থ ৩১২ মাইল। এটি প্রাচীন সমতটের অংশ, যা বিক্রমপুর ও পদ্মার দক্ষিণে অবস্থিত। আকবরনামায় বাগড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বিকাশ বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
রজনীকান্ত বাগড়ির ভাগ
রজনীকান্ত বাগড়ি তার বর্ণনায় সাতক্ষীরা অঞ্চলের দশটি দ্বীপ বা অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো:১. অন্ধ্রদ্বীপ২. সূর্যদ্বীপ৩. মধ্যদ্বীপ৪. জয়দ্বীপ৫. চক্রদ্বীপ৬. কুশদ্বীপ৭. এডুদ্বীপ৮. প্রবালদ্বীপ৯. চন্দ্রদ্বীপ১০. বৃদ্ধদ্বীপ।
বল্লাল সেনের জীবনের শেষ অধ্যায়
বল্লাল সেন ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি তার পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করেন এবং মহাদীক্ষায় দীক্ষিত হন। বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, তিনি সস্ত্রীক ত্রিবেনীর নিকট গঙ্গা তীরে বানপ্রস্থ অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করেন। এর অর্থ হতে পারে যে তারা স্বেচ্ছায় গঙ্গাগর্ভে আত্মত্যাগ করেছিলেন।
লক্ষ্মণ সেনের শাসনকাল
লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে রাজ্যে নানা অরাজকতার সৃষ্টি হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলায় আক্রমণ করে সহজেই নদীয়া দখল করেন। আক্রমণের পর লক্ষ্মণ সেন নৌকাযোগে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান। বিক্রমপুরে স্থানীয় কোমল পাল নামে একজন রাজা তার রাজত্বকালে খুলনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অধিকার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
বখতিয়ার খিলজীর শাসনকাল
বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। তবে এ শাসন পুরোপুরি স্থিতিশীল হতে প্রায় এক শতক সময় লাগে। বখতিয়ারের পরে আল মর্দান খিলজী ও গিয়াসউদ্দিন ইওজ খিলজী কর সংগ্রহের মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করতেন। এর ফলে সাতক্ষীরা-খুলনা অঞ্চল পুরোপুরি মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে না।
গিয়াসউদ্দিন বলবনের অভিযান
গিয়াসউদ্দিন বলবন সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কিছু অঞ্চল দখল করেন। তিনি সোনারগাঁও অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। এই সময় বরিশাল অঞ্চলের চন্দ্রদ্বীপে শাসন করতেন দশরথ দনুজমর্দন দেব।
সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসন
সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ তার শাসনামলে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা জয় করেন। এ থেকে ধারণা করা যায় সাতক্ষীরা অঞ্চলও তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ ও শাসসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের শাসন
ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরের বছর ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে শাসসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার বংশ এই অঞ্চলে দীর্ঘ সময় শাসন করে। ১৪১২ থেকে ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত ছিল। পরে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ ১৪৪২ সালে সিংহাসনে বসেন এবং শাহী বংশ পুনরায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে।
এই বিবরণে সাতক্ষীরা ও আশেপাশের অঞ্চলের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং সামাজিক পরিবর্তনের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
খানজাহান আলী, যিনি দক্ষিণ বঙ্গের মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে পরিচিত, একজন দরবেশ সেনাপতি ছিলেন। ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দক্ষিণবঙ্গ জয় করেন। বাংলার সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহের কাছ থেকে একটি সনদ প্রাপ্তির মাধ্যমে সুন্দরবন এলাকা পুনরুদ্ধার করে জনপদ গড়ে তোলার অধিকার পান। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনহিতকর কার্যক্রম দক্ষিণ বঙ্গকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
নাসিরউদ্দিন শাহের শাসনামল শেষে হোসেন শাহী বংশের নসরত শাহের শাসনামলেও সাতক্ষীরা অঞ্চল ওই রাজ্যের অংশ ছিল।
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে কররানী বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাজখান ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ভ্রাতা সুলেমান খানের শাসনামল ছিল স্থিতিশীল। তবে সুলেমান খানের পুত্র দাউদ খান কররানী এ বংশের আলোচিত শাসক। ১৫৭৩ থেকে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র তিন বছরের শাসনকালে দাউদ খান কররানী বহু নিকটাত্মীয়কে হত্যা করে ক্ষমতা সুসংহত করেন।
কররানী বংশের পতনের পর বাংলায় বারো ভূঁইয়ার আবির্ভাব ঘটে। দক্ষিণাঞ্চলের ভূঁইয়া হিসেবে ব্রাহ্মণ শ্রীহরি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। দাউদ কররানীর প্রধান পরামর্শদাতা শ্রীহরি মকুন্দপুরে রাজধানী স্থাপন করেন ও বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন। পরে ধুমঘাটে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। শ্রীহরির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রতাপাদিত্য রাজ্য সম্প্রসারণে মনোযোগ দেন। তিনি কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন।
প্রতাপাদিত্য ছিলেন দক্ষ প্রশাসক ও ক্ষমতাবান শাসক। মুঘলদের আনুকূল্য লাভের উদ্দেশ্যে ইসলাম খানের কাছে দূত প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে তাঁর দুটি যুদ্ধ হয়। প্রথম যুদ্ধ হয় ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে সালকায় এবং দ্বিতীয়টি ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে কাগারঘাটে। দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রতাপাদিত্য গিয়াস খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বন্দি অবস্থায় দিল্লি যাওয়ার পথে বেনারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে ধারণা করা হয়।
প্রতাপাদিত্যের পতনের পর খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চল জমিদারদের অধীনে চলে যায়। খান-ই-আজম মির্জা আজিজ কোকা মোঘলদের কাছ থেকে জমিদারি লাভ করেন। এই সময় উল্লেখযোগ্য জমিদার ছিলেন ভবেশ্বর রায়, মাহতাব রায়, কন্দর্প রায়, মনোহর রায় ও শ্রীকৃষ্ণ রায়।
১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে টিলম্যান হেংকেল যশোর অঞ্চলে প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ হিসেবে নিযুক্ত হন। একই বছর যশোরে প্রথম আদালত স্থাপিত হয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে হেংকেল যশোরের সীমানা চিহ্নিত করেন এবং যশোর পৃথক জেলা হিসেবে মর্যাদা পায়। সাতক্ষীরা অঞ্চল ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মহকুমার মর্যাদা পায় এবং নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরা চব্বিশ পরগণার সঙ্গে যুক্ত হয়।
খুলনা জেলা হিসেবে মর্যাদা পায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। লর্ড রিপনের প্রচেষ্টায় সাতক্ষীরা খুলনা জেলার মহকুমায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরা জেলা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে জেলায় ৭টি উপজেলা, ৮টি থানা, ৭৮টি ইউনিয়ন, ৯৬০টি মৌজা, ১৪২১টি গ্রাম এবং ২টি পৌরসভা রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় অবস্থিত। এর অবস্থান ২১°৩৬´ থেকে ২১°৫৪´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৫৪´ থেকে ৮৯°২০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১৬ ফুট। জেলার আয়তন ৩৮৫৮.৩৩ বর্গকিলোমিটার, যার এক তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মধ্যে ভূমি ১৪৪৫.১৮ বর্গকিলোমিটার। জেলার পূর্বে খুলনা, পশ্চিমে ভারতের চব্বিশ পরগণা, উত্তরে যশোর এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং এর ভূ-প্রকৃতিতে প্রধানত সমতল ভূমির আধিক্য থাকলেও অল্প কিছু অসমতল ভূমিও বিদ্যমান। ভূ-প্রকৃতিবিদগণ এই জেলার ভূমিকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করেছেন: ১) গাঙ্গেয় পলল ভূমি, ২) মিশ্র গাঙ্গেয় পলল ভূমি, এবং ৩) গাঙ্গেয় কটাল পলল ভূমি।
উত্তরাঞ্চলের মাটি শস্য উৎপাদনের জন্য বেশ উর্বর, যেখানে দক্ষিণাঞ্চলের মাটি লবণাক্ত ও এঁটেল প্রকৃতির। দক্ষিণাঞ্চলীয় নদীগুলো সমুদ্রের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হওয়ায় সেগুলো জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি নিয়ে আসে, যা দক্ষিণাঞ্চলের ভূমিকে প্লাবিত করে। ফলে এই অঞ্চলে শস্য উৎপাদন কম হয়। তবে ভেড়ীবাঁধ নির্মাণের ফলে মাছ চাষ ব্যাপক হারে প্রসারিত হয়েছে।
এছাড়া জেলার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভূমি সৃষ্টি ও ক্ষয়ের প্রক্রিয়া চালু থাকে। দক্ষিণাঞ্চলে নদীর পলি এবং পচনশীল উদ্ভিদের সংমিশ্রণে একটি বিশেষ ধরনের মাটি সৃষ্টি হয়, যা “জোব মাটি” নামে পরিচিত। সঠিকভাবে প্রস্তুতকরণের পর এই মাটিতে ভালো শস্য উৎপাদন সম্ভব।
জেলার জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমী ধরনের। শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এবং গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয়, যা জেলার উচ্চ বৃষ্টিপাতের জন্য দায়ী।
সাতক্ষীরার ইতিহাসে নানা ধর্ম, ভাষা ও পেশার মানুষের বসবাসের চিহ্ন পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে তাদের রেখে যাওয়া কীর্তি ও স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। তবে সংরক্ষণের অভাব, লবণাক্ত আবহাওয়া, এবং ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার ইত্যাদির কারণে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন আজ বিলুপ্তপ্রায়। তবুও, বিদ্যমান নিদর্শনগুলো বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, সাতক্ষীরা জেলার ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো বাংলাদেশ তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য।
সাতক্ষীরা জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত একটি বহুমাত্রিক ধারা তুলে ধরে। প্রাচীন সমাজবদ্ধ মানুষের বসতি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের গঠনের প্রতিটি পর্যায়ে এই অঞ্চল স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। এ জেলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, যেমন সুন্দরবনের অরণ্য, বুড়িগোয়ালিনী বা নদী-জলাশয়ের নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক জীবনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তদুপরি, প্রাচীন স্থাপনা, ধর্মীয় উপাসনালয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিবর্তন এই অঞ্চলকে একটি বহুমুখী পরিচয় দিয়েছে। সংরক্ষণ এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাতক্ষীরার ঐতিহ্য ও সম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা জরুরি। এর মাধ্যমে সাতক্ষীরা কেবল অতীতের সাক্ষী নয়, একটি ভবিষ্যতমুখী ঐতিহাসিক অঞ্চল হিসেবে বিশ্বে তার অবস্থান সুসংহত করতে সক্ষম হবে।
Leave a Reply