1. admin@gmail.com : দৈনিক আমার সময় : দৈনিক আমার সময়
  2. admin@dailyamarsomoy.com : admin :
ভাঙনের দগদগে ক্ষত নিয়ে সাতক্ষীরার ‌আশাশুনির ১০টি গ্রাম - দৈনিক আমার সময়

ভাঙনের দগদগে ক্ষত নিয়ে সাতক্ষীরার ‌আশাশুনির ১০টি গ্রাম

সিরাজুল ইসলাম, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি :
    প্রকাশিত : শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫

খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙনের দগদগে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ১০টি গ্রাম। ভাঙনের ৫দিন পর রিংবাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢোকা আটকানো হয়। কিন্তু আটকে থাকা পানিতে মরতে থাকে মাছ, ব্যাঙ, সাপসহ বিভিন্ন প্রাণি। লবণাক্ত পানিতে পঁচতে থাকে গাছপালা ও জমির ফসল। আটকে থাকা পানি দূষিত হয়ে এখন ছড়াচ্ছে বিকট দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধে এলাকায় টিকে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাঙন এলাকার একেকটি বাড়ি যেন ধ্বংসস্তূপ। ভেঙে গেছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। খাবার পানির সবগুলো উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। নলকূপে মিলছে না সুপেয় পানি। পঁচা পানির কামড়ে নারী, শিশু, বৃদ্ধ সবাই আক্রান্ত। সদ্য শিস বের হওয়া বোরো ধানের ক্ষেতে লবণাক্ত পানি ঢোকার কারণে মরে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। এলাকায় বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি শিশু খাদ্য ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে অনেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ব্লিচিং পাউডার ও পরিষ্কারক সামগ্রী সরবরাহের দাবি জানান তারা। ঈদুল ফিতরের দিন ‌সোমবার (৭ এপ্রিল) সরেজমিনে প্লাবিত এলাকায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে পাইপ লাইন ও বাক্সকলের মাধ্যমে মাছের ঘেরে নদীর পানি সরবরাহ করায় প্রতি বছর এভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয় বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। তারা বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে বাক্সকল স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।৩১ মার্চ ঈদুল ফিতরের দিন সকালে মানুষ যখন ঈদের নামাজে রত তখনই হঠাৎ ভাঙে আশাশুনির খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ। আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট এলাকায় বাঁধভেঙে উপজেলার ৬টি গ্রাম সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। এছাড়া আরও ৫টি গ্রাম আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাঙনস্থলের পাশেই বাস করেন সিদ্দিক গাজী। তিনি বলেন, ভাটায় ভাঙন আর জোয়ারে প্লাবন। ঈদের দিন সকালে ছিল খোলপেটুয়া নদীতে ভাটা। ভাটার সময় হঠাৎ নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। এরপর হুহু করে পানি ঢুকতে থাকে। এলাকায় তখনও ঈদের নামাজ শেষ হয়নি। ঈদের নামাজ শেষ করেই কাছা মেরে নেমে পড়েন বাঁধ বাঁধার কাজে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাতের জোয়ারে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়।এতে সিদ্দিক গাজীর ৫০বিঘা আয়তনের মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় তিনি এখন সর্বশান্ত। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন ও টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। একই কথা বলেন স্থানীয় ঘের মালিক শওকত হোসেনসহ অনেকেই।বল্লবপুর গ্রামের হারুন অর রশিদ জানান, ১২ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন তিনি। খোলপেটুয়ার নোনা জলে ভেসে গেছে তার সদ্য শিস বের হওয়া বোরো ধানের ক্ষেত। সবুজ ধানের ক্ষেত এখন ফ্যাকাশে হয়ে হয়ে গেছে। ধান তো ঘরে উঠবেই না বরং ঋণগ্রস্ত হয়ে গেলেন তিনি। বাঁধভাঙা খোলপেটুয়ার নোনা জলে সর্বনাশ হয়ে গেছে হারুন অর রশিদের মতো অনেক কৃষকের।এদিকে বিছট গ্রামের বেড়িবাঁধ ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আনুলিয়া ইউনিয়নের খোলপেটুয়া নদীর তীরবর্তী নয়াখালী গ্রাম। জোয়ারের পানিতে এই গ্রামের প্রায় সব ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ধসে পড়েছে গ্রামের প্রায়সব মাটির ঘর। গোবাদি পশু ও হাঁস মুরগিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে এই গ্রামের বাসিন্দারা। এই অবস্থায় গত রাতে গ্রামে ডাকাত দল ঢুকেছিল বলে অভিযোগ করেন গ্রামবাসী। এছাড়া ইউনিয়নের বিছট, বল্লভপুর, আনুলিয়া, চেঁচুয়া ও কাকবসিয়া গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় সেখানে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। তলিয়ে গেছে মিষ্টিপানির পুকুর। লোনা পানিতে পুকুরের মাছ মরে এলাকায় দুগন্ধ ছড়াচ্ছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সড়কের উপর বা আশে পাশের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।নয়াখালী গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা আতাউর রহমান জানান, এই এলাকায় আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে কোন বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি। যে কারণে বাঁধ ভেঙে আনুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নয়াখালী গ্রামের সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে মানুষ খুব কষ্টে আছে। গ্রামের মানুষ বেড়িবাঁধের উপর অবস্থান নিয়েছে। খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামবাসীর মধ্যে ডায়েরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনের আগে থেকে নজরদারি থাকলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।বিছট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম জানান, ভাঙন এলাকায় চুলকানি, পাঁচড়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে অনেকে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। শিশু খাদ্য ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।বিছট গ্রামের ঘের মালিক রুহুল আমিন মোড়লও একই দাবি জানিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে জীবন বাঁচাতে দরকার ত্রাণ সামগ্রী আবার বেঁচে থাকতে হলে দরকার টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ। টেকসই বেড়িবাঁধ না হলে এ অঞ্চলের মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।তিনি আরও বলেন, এলাকার প্রায়ই ঘেরে প্রথম কিস্তির মাছ ধরা শুরু হয়েছিল। মৌসুমের শুরুতেই চিংড়ি ঘের তলিয়ে যাওয়ায় সব ঘের মালিকরা আর্থিকভাবে সর্বশান্ত হয়ে গেছে।স্থানীয় আনুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস বলেন, ভাঙনের পরপরই গ্রামবাসীদের সাথে নিয়ে ভাঙন পয়েটে একটি বিকল্প রিংবাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুপুরের জোয়ারে সেই বাঁধ টেকানো সম্ভব হয়নি। নদীর পানিতে ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ত্রাণের দাবি জানান।সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম-সচিব আলী নূর খান বাবুল বলেন, উপকূল রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধের কোন বিকল্প নেই। যারা বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে উপকূলবাসিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি।সাতক্ষীরা জলবায়ু অধি-পরামর্শ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী মাধব দত্ত সোমবার সরেজমিন পরিদর্শন শেষে বলেন, আশাশুনির আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট এলাকার বাঁধ ভেঙে আনন্দের ঈদ ম্লান হয়ে যায়। এরপর সেখানে হাজারো মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন, আশাশুনি উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় রিংবাঁধের মাধ্যমে আপতত পানি আটকানো সম্ভব হয়েছে। তবে স্থায়ীভাবে পানি আটকাতে হলে দরকার টেকসই বেড়িবাঁধ। এছাড়া ত্রাণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট রয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে তাদের পুনর্বাসন করা জরুরী। মাছের ঘের ও ফসলের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনেও নজর দিতে হবে। মানুষের পাশাপাশি প্রাণিদের সুরক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এড. শেখ আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বাঁচার উপায় টেকসই বেড়িবাঁধ। দেশের ১৮টি জেলাজুড়ে রয়েছে উপকূল। উপকূল সুরক্ষার জন্য উপকূল বোর্ড গঠণের দাবি জানান তিনি।সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল হামিদ বলেন, আমরা জলবায়ু ন্যায্যতা চাই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। অথচ জলবায়ু সুরক্ষায় উপকূলীয় মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করছে।পাউবো বিভাগ-৮ (ঢাকা) এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (এসই) ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৬৬৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে অন্তত দশটি পয়েন্টে প্রায় চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। অবিলম্বে এসব ঝুকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো মেরামত করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক থেকে ফান্ড পাশ হলে টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।সাতক্ষীরা পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনের খবর পেয়ে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামকে পাঠানো হয়। ভাঙন মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা হবে।প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত ১১টি গ্রাম কমবেশি প্লাবিত হয়। এতে প্রায় সাড়ে চার হাজার বিঘা জমির আয়তনের ৪৫০ থেকে ৫০০টি চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। চাষীদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার সম্পদ। একই সাথে ২০ হেক্টর জমির বোরো ধান ও প্রায় দেড় হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালিন সবজি নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্লাবিত এলাকার প্রায় ৬শ’ ঘরবাড়ি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন
© All rights reserved © dailyamarsomoy.com