কক্সবাজারের টেকনাফে দুটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত দরে ডলার বিক্রি করে সেই অর্থ গোপন করার অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে ডলার সংকটের সুযোগে পছন্দের কিছু লোকের মাধ্যমে ফরেন ডিমান্ড ড্রাফটের (এফডিডি) সিরিয়াল-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে নেমেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে একটি ব্যাংকের সহকারী শাখা ব্যবস্থাপককে তাৎক্ষণিকভাবে বদলি করা হয়েছে।
অন্য ব্যাংকের এফডিডি লেনদেন বন্ধ রাখা হয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার সঙ্গে দুটি ব্যাংকেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। জানা যায়, ডলার সংকটের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো এলসি (ঋণপত্র) খোলা বন্ধ রাখলেও টেকনাফ স্থলবন্দরে ব্যবসা চলছিল। সেখানকার ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পণ্য খালাস করতে এফডিডি খুলে থাকেন। তাঁরা শুধু ওই দুই ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকেই এফডিডি খোলার সুযোগ পান।
একজন ব্যবসায়ী তাঁর লাইসেন্সের বিপরীতে প্রতিদিন ৩০ লাখ ও ৫০ লাখ টাকার সমমূল্যের ডলারের এফডিডি খুলতে পারেন। আগে যেকোনো ব্যবসায়ী প্রতিদিন এফডিডি করতে পারলেও ডলার সংকটের পর তালিকা করে কিছু লোককে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এই সুযোগে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা শুরু করেন তালিকা-বাণিজ্য। ক্ষমতা দেখিয়ে ও টাকার বিনিময়ে একটি চক্র তালিকা নিয়ে তা প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কাছে কয়েক লাখ টাকায় বিক্রি করেন। একপর্যায়ে লোভ হয় ব্যাংক দুটির কর্তৃপক্ষেরও। চাহিদা থাকায় তারা নির্ধারিত দামের চেয়ে ডলারপ্রতি ৭-৮ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করে বাড়তি অর্থ গোপন করতে থাকে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক গতকাল রোববার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাংকের তদন্তাধীন বিষয়ে আমরা কথা বলি না। তদন্ত শেষ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তখন জানাতে পারব।’
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের টেকনাফ শাখার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডলার কারসাজি করে কর্মকর্তারা স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রেখেছেন। পাশাপাশি এফডিডি করতে চাওয়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেওয়া মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংকের বিশেষ হিসাবে স্থানান্তর করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের টেকনাফ শাখার এফডিডির অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, ‘টেকনাফ শাখার এফডিডি নিয়ে অভ্যন্তরীণ অডিট চলছে। কাজ শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না।’
মঙ্গলবার সোনালী ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় গিয়ে দেখতে পান, ব্যাংকটির তদন্ত কমিটির প্রধান ও প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম (অডিট) সাইফুল ইসলাম সেখানে তদন্ত করছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডলার সিন্ডিকেটের ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগ তিনি পেয়েছেন। সেই তদন্ত করতে এমডি তাঁকে সরেজমিনে পাঠিয়েছেন। তদন্ত শেষে ঢাকায় ফিরে প্রতিবেদন দেবেন।
এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজালকে ফোন করা হলে তিনি এসএমএস পাঠাতে বলেন। দু-তিন দফা বার্তা বিনিময় হলেও প্রশ্ন করার পর কোনো জবাব দেননি। এরপর ফোন করা হলেও ধরেননি।
কারসাজির শুরু যেভাবে
দেশে ডলার সংকটের পর স্থলবন্দরে এই দুই ব্যাংকে এফডিডি একসঙ্গে হতো না। কখনো ৩৫০ জন লাইসেন্সধারী সোনালী ব্যাংকে এফডিডি করতে পারতেন। আবার কখনো এবি ব্যাংকের ৫৫০ জন লাইসেন্সধারী সুযোগ পেতেন। অবশ্য কিছু ব্যবসায়ী দুই ব্যাংকেরই লাইসেন্সধারী ছিলেন। দুই শাখা পালা করে এফডিডি কার্যক্রম চালানোর কারণে একচেটিয়া মুনাফার সুযোগ তৈরি হয়। তবে ব্যাংকগুলো ১৫-২০ জনকে এফডিডির সুযোগ দিত বলে জানা গেছে।
ডলারে দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগ ওঠায় এবি ব্যাংক গত ২৮ মার্চ এফডিডি করা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। পরে এপ্রিলে তা ১৮ দিন চালু রাখে সোনালী ব্যাংক।
বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেন ১৫-২০ জনের যে চক্র, তার বাইরে কেউ তখন সোনালী ব্যাংকে এফডিডি করার সুযোগ পেতেন না। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ব্যাংকটির সহকারী শাখা ব্যবস্থাপক নুরুল বশর প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে নিজের মতো করে তালিকা তৈরি করতেন। সে অনুযায়ী প্রতিদিন ১৫-২০ জনকে টাকার বিনিময়ে এফডিডি করার সুযোগ করে দিতেন। পরে ২ লাখ টাকা বেশি নিয়ে তাঁরা সেই ডলার অন্য ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করতেন। নিরুপায় হয়ে ব্যবসায়ীরা তা কিনে বন্দর থেকে পণ্য ছাড়িয়ে ক্ষতির মুখে পড়তেন। পরে ব্যবসায়ীদের হইচইয়ের মুখে প্রধান কার্যালয় বিষয়টির তদন্তে নামে।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসে নুরুল বশরকে বান্দরবানে বদলি করা হয়। অবশ্য নুরুল বশর দাবি করেন, এই দায় তাঁর একার নয়। গত বুধবার তিনি বলেন, শুরুতে নিজেরা সিরিয়াল দিতে পারলেও পরে সবকিছু প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে করেছেন।যে তালিকা প্রধান কার্যালয় থেকে আসত, সে অনুযায়ী শাখা ব্যবস্থাপকের নির্দেশে এফডিডি করা হতো।
নুরুল বশর স্বীকার করেন, তিনি যতটুকু দোষ করেছেন, সে জন্য তাঁকে বদলি করা হয়েছে। তালিকায় কাদের নাম রাখা হতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানকার অনেক ব্যবসায়ী ওপর মহলে তদবির করতেন। তাঁদের নাম তালিকায় রাখা হতো। এর বাইরেও স্থানীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির লোকজনের নামেই প্রতিদিন চারটি করে এফডিডি করতে হতো।
এভাবে তালিকা তৈরি করার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দু-একটা নাম বলা হয়ে থাকতে পারে। হয়তো ওখান থেকে (শাখা) আরও বাড়িয়ে নিজেদের মতো করে করা হয়েছে।’
এবি ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ব্যাংকটি প্রত্যেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এফডিডি বাবদ অতিরিক্ত ২ লাখ টাকা নিয়েছে। এই টাকা রাখার জন্য একটি হিসাব নম্বর ব্যবহার করলেও টাকা জমা করার স্লিপ বা রসিদ ব্যাংকে রেখে দিত। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিক্রিয়া দেখালে সিস্টেম আপডেট করার অজুহাতে ডলার ছাড়া বন্ধ করে দেয় ব্যাংকটি। অবশ্য তার আগের এক মাসে দিনে ৪০ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়। এরপরই তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা যায়, এবি ব্যাংকের প্রায় ৫৫০ জন লাইসেন্সধারীর মধ্যে ১৫-২০ জন প্রতিদিন এফডিডির বিশেষ সুবিধা পেতেন।
সুবিধাভোগী কয়েকজন জানান, স্বাভাবিকভাবে কোনো ব্যবসায়ী যখন ৩০ হাজার ডলার ড্রাফট করতেন, তখন ডলারের সরকারি দর অনুযায়ী ৩০ লাখ টাকার মতো দিতে হতো। কিন্তু একসময় সোনালী ব্যাংকে ড্রাফট-সুবিধা বন্ধ থাকায় সব ব্যবসায়ী এবি ব্যাংকের শরণাপন্ন হলে একচেটিয়া ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠানটি। তারা ডলারপ্রতি ৭-৮ টাকা বাড়িয়ে নিতে থাকে। তখন ৩০ হাজার ডলারের এফডিডি করতে বাড়তি প্রায় ২ লাখ টাকা দিতে হয় একটি নির্দিষ্ট হিসাব নম্বরে।
অনুসন্ধানে টাকা জমা নেওয়ার একাধিক স্লিপ থেকে ওই হিসাব নম্বর (জিআই এসি ৪০০১৮৭০১০০০৫০) পাওয়া গেছে। জানা যায়, এটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়েরই হিসাব নম্বর। ১ মার্চের একটি রসিদে দেখা যায়, সেদিন ব্যাংকটি ডলারের দর ধরেছিল ১১২ টাকা, কিন্তু প্রকৃত দর ছিল ১০৪ টাকা ৪৫ পয়সা।
ব্যবসায়ীদের সেদিন ৩০ হাজার ডলার এফডিডি করতে বাড়তি দিতে হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৫৩ টাকা। ২২ মার্চের আরেকটি রসিদে দেখা যায়, ব্যাংকটি সেদিন ডলার বিক্রি করে ১১৩ টাকা ৬ পয়সা দরে। যদিও নির্ধারিত দাম ছিল ১০৫ টাকা ১০ পয়সা। সেদিন ৩০ হাজার ডলারের এফডিডি করতে একজন ব্যবসায়ীকে বাড়তি দিতে হয় ২ লাখ ৫৬ হাজার ২৮৬ টাকা। এভাবে ১৫-২০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকা বাড়তি নেওয়া হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই ব্যাংক ছাড়া এফডিডি করার সুযোগ না থাকায় ব্যবসা চালিয়ে যেতে অতিরিক্ত টাকা দিয়েও আমরা এফডিডি করতাম। তা না হলে পণ্য বন্দরে নষ্ট হয়ে যেত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এবি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম ডলার দেওয়ায় তাঁরা প্রবাসী আয় থেকে ডলার কিনে তা ব্যবসায়ীদের দিতেন। তাই ডলার কেনার খরচ বেশি পড়া এবং লাভ করতে গিয়ে দাম বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল।
দুই ছাত্রীর নামেও লাইসেন্স
গত ১৭ এপ্রিল সোনালী ব্যাংকে এফডিডি করা ১৫ জনের তালিকায় দেখা যায়, স্থানীয় এক কলেজশিক্ষকের কলেজপড়ুয়া দুই মেয়ের নামে লাইসেন্সের বিপরীতে দুটি এফডিডি করা হয়। জানা যায়, তাদের নামে বন্দরে সেই মাসে কোনো পণ্য আসেনি।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের টেকনাফ শাখার ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘কাগজপত্র ঠিক হয়ে আমাদের কাছে এলে তাঁদের নামে লাইসেন্স করে দিই। সেগুলো তাঁরা কীভাবে সংগ্রহ করেন বা তাঁরা প্রকৃত ব্যবসায়ী কি না, সে বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।’
টেকনাফ স্থল বন্দর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সভাপতি আমিনুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, ‘যেভাবে ব্যাংক দুটো এফডিডি করতে দিচ্ছে, এভাবে ব্যবসা করা যায় না। স্করিয় বন্দর এখন একদম নিষ্ক্রিয় করে পড়েছে। মুষ্টিময় কয়েকজন ছাড়া সাধারণ কোন ব্যবসায়ীরা এখন কেউ ভালো নেই।
’ ব্যবসায়ী মো. শফিক ও আদিব রহমান সহ আসিফুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক দুটি কাউকে বুকে রাখে, আবার কাউকে পিঠে রাখে। এবি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মুনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে সবকিছু প্রধান অফিসকে জানিয়েই করা হয়েছে।
Leave a Reply