জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে, আবহাওয়া আরও চরম হচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো প্রকৃতি, বণ্যপ্রাণী, মানববসতি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মানুষের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী। যদি আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না গ্রহণ করি, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে জলবায়ু সংকট হিসেবে বর্ণনা করেন। জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী মানুষের জন্যে একটি ভয়াবহ দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এখন আর শুধু পরিবেশগত বিষয় নয়। বিশ্বের আবহাওয়া পরিবর্তন বিশ্ব নিরাপত্তার বিষয় হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। সকলেই জানেন, বিশ্বের আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রধান কারণ ভূমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ দ্রুত গলতে শুরু করছে। এ বরফগলা পানি প্রবাহিত হয়ে নদনদী ও সাগরকে স্ফীত করে তুলছে। এ কারণে নদী ও সাগর তীরবর্তী অঞ্চল বেশি প্লাবিত হচ্ছে। প্লাবন, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ল-ভ- হচ্ছে মানুষের বসতবাটি; নষ্ট হচ্ছে কৃষি, মৎস্যচাষ তথা খাদ্য উৎপাদন। বিপর্যস্ত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এর ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। মানুষ আর্থিকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে দারিদ্র্য। ক্ষুধার্ত মানুষ আজ খাদ্যের জন্য দাঙ্গায় লিপ্ত হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্যবাহী বহরে আক্রমণ করছে আফ্রিকার ক্ষুধাপীড়িত মানুষ। আগামী দশকেই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনে চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে। বেশিমাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে বেশি ক্ষতি হয়েছে পানির। লোনা পানির আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে গোটা বিশ্বে পরিবেশের বিপর্যয় ও জলবায়ুর পরিবর্তন বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। কয়েক শত বছর আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়েছে। জনসংখ্যার আধিক্য, শিল্পবিপ্লব, গাছপালা উজাড় করে দেওয়া, পাহাড় কাটা তথা প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করা থেকে বায়ু মন্ডলের উষ্ণতা বেড়েছে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের জলবায়ুর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং মৌলিক চরিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষ একের পর এক বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ ও জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে না পারলে নানাভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। পরিবেশের সুরক্ষা মানুষের সুশৃঙ্খলের উপর নির্ভর করে। মানুষ যত পরমতসহিষ্ণু হবে জলবায়ুর পরিবর্তন হবে ইতিবাচক এবং পরিবেশের ভারসাম্য স্থিতিশীল থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রীনহাউজ এফেক্ট। শক্তি উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়ানোর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বনডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেনসহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস বৃদ্ধি পায় এবং এই গ্যাসগুলো আমাদের বায়ু মন্ডলকে উত্তপ্ত করে চলছে প্রতিনিয়ত। ফলাফল স্বরূপ মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, যার কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী নি¤œ অঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। বরফ গলে যাওয়ার কারণে মেরু অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: এসিড বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, অধিক পরিমাণে বৃক্ষ নিধন এবং নতুন নতুন শিল্পকারখানা প্রতিস্থাপন। এসব কারখানা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত করে চলেছে। এই সকল গ্যাস পরিবেশ এবং জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে বৃক্ষের রয়েছে এই সকল ক্ষতিকর গ্যাস গ্রহণ করে সেগুলোকে অক্সিজেনে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা। কিন্তু আমরা সেই বৃক্ষগুলোকে নিধন করে চলেছি। বনের পর বন উজাড় করে চলছে শিল্প কারখানা এবং নতুন নতুন ভবন তৈরি করার কাজ। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী আমরা মানুষরাই। তাই আগে আমাদের ভুলগুলো শুধরে নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে এবং যে সব শিল্পকারখানা বায়ুতে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন করে, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অতঃপর আশা করা যায়, পৃথিবীর জলবায়ু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের উপর নির্ভরশীল, যেমন- জৈব প্রক্রিয়াসমূহ, পৃথিবী কর্তৃক গৃহীত সৌর বিকিরণের পরিবর্তন, ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ইত্যাদি। তবে বর্তমান সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বললে সারা পৃথিবীর ইদানিং সময়ের মানবিক কার্যকর্মের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন বোঝায়, যা ভুমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বাতাস ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়। জলবায়ু ব্যবস্থার পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি সামগ্রিক উষ্ণায়ন প্রবণতা এবং আরও চরম আবহাওয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে, যেমন বনের দাবানল এবং মরুকরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষ নানাভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে খাদ্য ও মিঠা পানির উৎস হুমকির মুখে পড়তে পারে। আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন বা সংক্রামক রোগের বিস্তারের মতো তীব্র প্রভাবের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়তে পারে। অর্থনৈতিক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে কৃষি, মৎস্য এবং বনায়নের পরিবর্তন। উচ্চ তাপচাপের কারণে গ্রীষ্মম-লীয় অক্ষাংশের বহিরঙ্গনে ক্রমবর্ধমানভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দ্বীপ দেশ এবং উপসাগরীয় শহরগুলি প্লাবিত হতে পারে। কিছু গোষ্ঠীর মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। যেমন দরিদ্র শিশু ও প্রান্তিক অধিবাসীরা। শিল্পোন্নত দেশগুলি যারা কার্বন ডাই অক্সাইডের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্গত করছে, তাদের বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় বেশি সম্পদ রয়েছে। ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনা স্থানচ্যুতি এবং অভিবাসনের দিকে পরিচালিত করতে পারে। গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। এই উষ্ণায়নের ফলে আমাদের পরিবেশ এবং জীবজগতের উপর ভহাবহ প্রভাব পড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি মাটি শুষ্ক করে ফেলছে এবং দাবানলের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ভূমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে এবং খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতির জীব বেঁচে থাকার জন্য শীতল অঞ্চলের দিকে পরিযায়ন করছে। স্থলভাগের অনেক প্রজাতি উঁচু অঞ্চলে চলে যাচ্ছে যেখানে তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। সামুদ্রিক প্রাণীরা গভীর সমুদ্রে আশ্রয় নিচ্ছে, যেখানে পানি ঠান্ডা। যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি বেড়ে যায় তবে প্রায় ১০% স্থলজ প্রজাতি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আমাদের গ্রহের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি। এটি ইতিমধ্যেই পৃথিবীর জলবায়ুর ব্যবস্থার সকল স্তরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিচ্ছে। উদ্বেগজনকভাবে, এই পরিবর্তন পৃথিবী জুড়ে সমানভাবে বিতরণ করা হয় না। অধিকাংশ ভূমি অঞ্চল মহাসাগরীয় অঞ্চলের তুলনায় দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে, উত্তর মেরুর অঞ্চল (সুমেরু অঞ্চল) বাকি অঞ্চলগুলোর তুলনায় দ্রুতহারে উষ্ণ হচ্ছে। এছাড়াও রাতের তাপমাত্রা দিনের তাপমাত্রার তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে পৃথিবীর তাপমাত্রা কতটা বৃদ্ধি পাবে তা নির্ভর করবে আমরা গ্রহকে রক্ষা করার জন্য কতটা পদক্ষেপ গ্রহণ করি তার উপর। এই উষ্ণায়নের প্রভাব প্রকৃতি এবং মানুষের উপর ব্যাপক আকারে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুমান করার জন্য বিজ্ঞানীরা নানা পদ্ধতি ব্যবহার করেন। একটি উপায় হচ্ছে অতীতের প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তন সন্ধান করা, অতীতে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন উৎসের সাহায্য নেন যেমন- গাছের বর্ষ বলয় বরফের স্তর প্রবাল এবং সমুদ্র ও হৃদয়ের পলি। এই সমস্ত অধ্যয়ন থেকে বোঝা যায় যে সাম্প্রতিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি গত ২০০০ বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। এই ২১তম শতাব্দীর শেষের দিকে তাপমাত্রা এমন একটি পর্যায় বৃদ্ধি পেতে পারে, যা সর্বশেষ ৩০ লক্ষ বছর আগে প্লাইওসিন যুগে দেখা গিয়েছিল।
Leave a Reply