জমি থেকে বাজার সবখানেই মধ্যস্বত্বভোগী। পুরো মৌসুমেই দালালদের কাছে অসহায় উপকূলের প্রান্তিক লবণ চাষি। জমি থেকে শুরু করে মাঠের পলিথিন কেনা ও লবণ বিক্রি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ দালাল চক্রের হাতে। লাগাম টানতে সরকারের সহযোগিতা চান তারা। আর মধ্যস্বত্বভোগীদের তালিকা করে প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার আশ্বাস বিসিক কর্তৃপক্ষের।
উপকূলে মাঠের পর মাঠ; তীব্র গরমে লবণ মাঠ তৈরি করেন চাষিরা। তারপর মাঠের ওপর কালো ত্রিপল বিছিয়ে সমুদ্রের লোনাপানি জমিয়ে তাতে দেয়া হয় সূর্যের তাপ। আর তাপে পানি শুকিয়ে তৈরি হচ্ছে লবণ। তীব্র গরমের মাঝে লবণ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রান্তিক চাষিরা।
কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের এসব লবণ চাষিরা পুরোপুরি জিম্মি দালাল চক্রের কাছে। তাদের দাবি; চাষিদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে দালাল চক্র খুলে বসেছে শোষণের দোকান। জমি বর্গা থেকে ত্রিপল কেনা এবং লবণ বিক্রি সবকিছুই দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণে। যার পরিত্রাণ চান প্রান্তিক লবণ চাষিরা।
চৌফলদন্ডী এলাকার লবণচাষি আজগর বলেন, জমির মালিকরা আমাদেরকে জমি বর্গা দেয় না। তারা দালালদেরকে জমি বর্গা দেয়। দালালদেরকে ২৫ হাজার প্রতি কানি বর্গা দিলে সে জমি দালালরা আমাদেরকে বর্গা দেয় ৩৫ হাজার টাকা। বাধ্য হয়ে আমাদের দালালদের কাছ থেকে জমি বর্গা নিতে হয়।
আরেক চাষি নুরুল আমিন বলেন, দালাল চক্র প্রতিমণ লবণে ১০০ টাকা করে কমিশন নেয়। এছাড়াও পলিথিন কেনা বাবদও ২০ থেকে ৩০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের বাইরে গিয়ে পলিথিনও কেনা যায় না। সবই সিন্ডিকেটের দখলে।
লবণ চাষি হুমায়ুন বলেন, যেখানে একমণ লবণ ৪০ কেজি। সেখানে দালাল চক্র আমাদের কাছ থেকে নেয় ৫০ থেকে ৫১ কেজি লবণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হয় আমাদের। দুঃখ করে তিনি বলেন, কবে যে তাদের কাছ থেকে রক্ষা পাব।
চলতি মৌসুমে প্রান্তিক লবণ চাষিরা মাঠ পর্যায়ে প্রতিমণ লবণ বিক্রি করেছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। কিন্তু এখন সে লবণের দাম নেমে এসেছে ৪০০ টাকায়। এই টাকার একটি অংশ নীরবে চলে যাচ্ছে দালালদের হাতে। তাই সরকারিভাবে জমি বর্গার মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ ব্যবসায়ী নেতাদের।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্টি’র সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে লবণ চাষিদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। এখন লবণ চাষের জমি যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি লবণ চাষিও বেড়েছে। কিন্তু লবণ চাষিদের শোষণ করা কমেনি। লবণচাষিরা দালাল চক্রের কাছে জিম্মি। এ অবস্থায় সরকারিভাবে জমির বর্গার দাম নির্ধারণ এবং দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তাহলেই কেবল প্রকৃতপক্ষে লবণ চাষিদের মুখে হাসি ফুটবে।
তবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প করপোরেশন বিসিক বলছে; তালিকা করে প্রশাসনের মাধ্যমে দালাল চক্রকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হবে।
কক্সবাজারস্থ বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, লবণ মিলারদেরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যাতে তারা সরাসরি মাঠ পর্যায়ে গিয়ে চাষিদের কাছ থেকে লবণ ক্রয় করে। এতে হলে আর মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিতে পারবে না। তারপরও চেষ্টা করছি, মধ্যস্বত্বভোগীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা চলছে।
গেলবছর উপকূলের ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হলেও এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার একরে। আর চাষির সংখ্যাও ৩৯ হাজার থেকে বেড়ে এখন ৪০ হাজারের বেশি।
হঠাৎ কেন কমলো দাম?
চলতি মৌসুমে কক্সবাজার উপকূলে বেড়েছে লবণ চাষের জমি, বেড়েছে চাষিও। কিন্তু মৌসুমের ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো উৎপাদিত হয়নি কাঙ্খিত লবণ। চাষিরা বলছেন, আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় লবণ উৎপাদন কম হয়েছে। এখন আবহাওয়া অনুকূলে হওয়ায় লবণ উৎপাদন বাড়লেও মণপ্রতি এক’শো থেকে দেড়’শো টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে লবণ। যাতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা। আর বাকি মাসগুলোর মধ্যেই লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প করপোরেশন বিসিক।
কক্সবাজার সদর উপজেলার মাতব্বর পাড়া, এই উপকূলে গেলো কয়েকবছর মাঠ পর্যায়ে লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেকেই ছেড়েছিলেন লবণ মাঠ। কিন্তু গেলবছর মাঠ পর্যায়ে লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হওয়ায় এবার আগে ভাগেই মাঠে নামে চাষিরা।
তীব্র রোদ, এই রোদের মধ্যে চলছে লবণ মাঠ তৈরির কাজ। কেউ মাঠে লবণাক্ত পানি ঢুকাচ্ছেন আবার কেউ কেউ মাঠে লবণ উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে চাষিরা বলছেন, চলতি মৌসুমের ৪ মাস আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় কাঙ্খিত লবণ উৎপাদন হয়নি।
লবণ চাষি হারুন বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৪ মাসে অন্তত এক কানি জমিতে ৩’শ মণের মতো লবণ উৎপাদন হত। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় গেলো ৪ মাসে মাত্র কানি প্রতি উৎপাদন হয়েছে ১’শ ১০ মণ লবণ।
আরেক লবণ চাষি ইলিয়াছ বলেন, চলতি মৌসুমের শুরু থেকে আবহাওয়া পরিস্থিতি ভাল ছিল না। কুয়াশা বেশি ছিল আর সূর্যের দেখা মিলেনি অনেক সময়। তাই লবণ উৎপাদন কম হয়েছে।
তবে ৪ মাস পেরিয়ে পহেলা মার্চ থেকে আবহাওয়া অনেকটা অনুকূলে। যার কারণে মাঠে ব্যস্ততা বেড়েছে চাষিদের। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের পর উৎপাদিত হচ্ছে লবণ। যা মাঠেই মজুদ করছেন চাষিরা।
তবে চাষিদের দাবি, কয়েকদিন ধরে মাঠে লবণ উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ অদৃশ্য কারণে মণপ্রতি লবণের দাম কমেছে এক’শো থেকে দেড়’শো টাকা। যা নিয়ে দুশ্চিতায় পড়েছেন তারা।
চৌফলদন্ডীর মাতব্বর পাড়ার লবণ চাষি মাহামুদুল বলেন, এখন লবণ উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লবণ দাম কমে যাচ্ছে। মৌসুমের শুরুতে মণপ্রতি লবণ বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। কিন্তু এখন সেই লবণের দাম কমে বিক্রি করতে হচ্ছে ৩৭০ থেকে ৪০০ টাকায়।
আরেক চাষি আনসারুল করিম বলেন, লবণ দামও এখন দালাল চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। তারা চাষিদের কাছ থেকে কম দামে লবণ।
Leave a Reply